বাংলা ভাষা ও আমাদের অর্জন
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের আজকের দিনে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে রাজপথ রঞ্জিত করেছিলেন সালাম, রফিক, শফিক, জব্বার, বরকতসহ নাম না জানা বাংলার দামাল ছেলের দল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল তাদের সে ত্যাগ। গড়ে দিয়েছিল বাঙালি জাতির চিরদিনের অহংকার। এ আন্দোলনের হাত ধরে সম্ভব হয়েছে দাসত্ব দূর করে স্বাধীনতা অর্জন। পৃথিবীতে আর কোনো জাতিকে ভাষার জন্য এত বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে কি না ইতিহাসে তার নজির নেই। ভাষা যে একটি জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন তা বাঙালি জাতি বুকের রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছে। বর্তমানে বিশ্বের সমৃদ্ধিশালী ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার অবস্থান চতুর্থ। বিশ্বের প্রায় ৪০ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই ভাষার টানে নাড়িতে ফিরেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কানাডা প্রবাসী কয়েকজন শ্রেষ্ট ও দেশ প্রেমি বাঙালি সুর্য সন্তানের অক্লান্ত প্রচেষ্টা আর তীব্র প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাংলা ভাষাকে ১৯৯২ সালে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বিশ্বের প্রতিটি জাতিকে তার মাতৃভাষাকে সম্মান জানাতে শিখিয়েছে বাংলা ভাষা। প্রতিটি ভাষা গতিশীল আর পরিবর্তনশীল। প্রতিনিয়ত ভাষায় যুক্ত হচ্ছে নানান বৈচিত্র্যতার রঙ। এই গতিশীল প্রক্রিয়ায় ভাষা যে সবসময় সঠিক পথে চলছে তা নয়। ইতিবাচক বিষয়ের পাশাপাশি যুক্ত হচ্ছে নানা অসঙ্গতিসহ ভাষা বিকৃতির বিভিন্ন ধরন। রক্ত দিয়ে কেনা বাংলা ভাষার এই বিকৃতি একবিংশ শতকে রীতিমতো আমাদের লজ্জায় ফেলেছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ভাষাকে ব্যবহার করা হচ্ছে নানা ভাবে। ইন্টারনেট, গণ যোগাযোগ মাধ্যম, এফ.এম রেডিও, সিনেমা, নাটকে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। বাংলা ভাষা যেভাবে বিকৃত করা হচ্ছে, দিনে দিনে তাতে মনে হয় ভুলে গেছি ভাষা আন্দোলনের কথা। ভুলে গেছি আমাদের সূর্যসন্তান সালাম, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেকে শহীদের আত্মত্যাগের কথা। দিনে দিনে বাংলা ভাষার বিকৃতি চলছে নগ্নভাবে। বর্তমান এই বিজ্ঞানের যুগে গণমাধ্যম গণমানুষের কাছে পৌঁছে যায় খুব সহজেই। কিন্তু গণমাধ্যমে ভাষার ব্যবহার লক্ষণীয়। দায়িত্বহীন গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে আপত্তি রয়েছে। যুবসমাজ যদি গণমাধ্যমের এই বিকৃত ভাষার প্রতি আকর্ষণবোধ করে, তাহলে এর পরিণতি হবে খুব ভয়াবহ। কোন ধরণের গণমাধ্যমে যেমন আঞ্চলিক ভাষা চলে না, ঠিক তেমনি বিকৃত ভাষাও চলতে পারে না। বর্তমানে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির আলোকে সবচেয়ে বহুল প্রচলিত সিরিয়ালগুলোতে এক অদ্ভুত ভাষা তৈরি হচ্ছে, যা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে বোধগম্যহীন। নাটকের সংলাপ বা বিজ্ঞাপনে বিকৃত ভাষার ব্যবহার ভাষার অস্তিত্ব নিয়েও টানাটানি হতে পারে। এফএম রেডিও চ্যানেলগুলো বাংলা ভাষাকে যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে ব্যবহার করছে। সেখানে ভাষা ব্যবহারের ভয়াবহতা নতুন করে ভাবিয়ে তোলে। কখনও ইংরেজি-বাংলার, কখনও হিন্দি, যে যেভাবে পারছেন বাংলা ভাষাকে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামিয়ে ফেলছেন। উচ্চারণের ক্ষেত্রে শোনা যায় নানা ধরনের ভঙ্গি, যা ভাষাকে প্রকৃত অর্থে ভিন্ন পথে ধাবিত করছে। ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে তরুণ প্রজন্মই সবচেয়ে বড় শক্তি। সেই তরুণ প্রজন্মের ওপর সবচেয়ে প্রভাব ফেলে এফএম রেডিও চ্যানেলগুলো। এসব ভাষা অবলীলায় প্রয়োগ করছে, যা আমাদের জন্য কোনোভাবেই কল্যাণকর নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং এফএম রেডিওগুলোতে ভাষার মাসেও বিকৃত উচ্চারণে কথা বলা বন্ধ হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে বাংলা বানানের বিকৃতি ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। এখানে ভুলের চেয়ে বিকৃতিই বেশি। বাংলা-ইংরেজির মিশ্রণ, বাংলা শব্দের মনগড়া সংক্ষিপ্ত রূপ, নতুন শব্দ তৈরি ও ব্যবহার ইদানীং ‘ফ্যাশন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহার হচ্ছে ভাল্লাগসে (ভালো লাগছে), মাইরালা (মেরে ফেল) ইত্যাদি। ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, ভাষায় নতুন শব্দ আসবে, ভাষার পরিবর্তন হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভাষার জন্য যা ক্ষতিকর তা হল একাধিক ভাষার মিশ্রণ। সেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, এফএম রেডিও এবং বিলবোর্ডগুলোতে লেখা যেন রীতিমতো ভাষা বিকৃতির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বাংলাদেশে যুবসমাজের কাছে ফেসবুক খুব জনপ্রিয়। ফেসবুকে বাংলা লেখার ধরনও অদ্ভুত। শব্দের বিকৃত বানান ও উচ্চারণ। যেমন-বেসম্ভব (অসম্ভব), কিন্যা (কিনে), গেসে (গেছে) দ্যাশ (দেশ)। এ রকম অসংখ্য বিকৃত ব্যবহার চলছে সবসময়ই। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মিলিয়ে বলা হচ্ছে মাগার, টাস্কিভূত, সম্ভাবিলিটি, বিন্দাস। বর্তমান সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা মৌখিকভাবে যে ভাষা ব্যবহার করছে না আঞ্চলিক, না প্রমিত। শুদ্ধ-অশুদ্ধের ভেজালে সে এক অন্য ভাষা। যেমন ‘এসেছ’, শিক্ষার্থীরা বলছে ‘আসছ’, ‘করেছিস’-কে শিক্ষার্থীরা বলছে ‘করছিস’, এভাবে ‘তাহলে’-কে ‘তাইলে’, ‘পাঁচটা’-কে প্যাঁচটা। এই একবিংশ শতকে তরুণসমাজ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যে ভাষা ব্যবহার করছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সে এই মিশ্র ভাষার নাম দিয়েছেন বাংহিংলিশ। হিন্দি ও ইংলিশকে বাংলার সঙ্গে এমনভাবে মিশিয়ে কথা বলছে, যেন ভাষার নতুন একটি রূপ তৈরি হয়েছে। ২০১৪ সালের ২৪ জুন আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন ও বেতারে বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে একটি কমিটি গঠন করে সরকার। দশ সদস্যের এ স্থায়ী কমিটির প্রধান তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (সম্প্রচার)। কমিটি সরকারি ও বেসরকারি ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম তথা সব টেলিভিশন চ্যানেল ও বেতারে সংবাদ, অনুষ্ঠান ও উপস্থাপনায় বাংলার সঙ্গে অহেতুক অন্যান্য ভাষার মিশ্রণ পরিহার করা ও ভাষাকে বিকৃত না করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যক্রম সমন্বয় করবে। এ ছাড়া টেলিভিশন চ্যানেল ও বেতারে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্রভাষার ব্যবহার বন্ধ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, অগ্রগতি পরিবীক্ষণ ও এ বিষয়ে অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় সাধন, বাংলা ভাষার দূষণ, বিকৃত উচ্চারণ, বিদেশি ভাষার সুরে বাংলা উচ্চারণ রোধের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে এ কমিটি। অথচ পরবর্তী সময়ে এ কমিটির কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানা যায়নি।