বাঙালি কত দিনের – অধ্যাপক সাইফুদ্দীন চৌধুরী

বাঙালি আমরা কতদিনের? এই ইতিহাস এখনও প্রায় অস্বচ্ছ। বাঙালি জাতির ইতিহাস নেই বলে এক সময় আপেক্ষ করেছিলেন স্বয়ং সাহিত্য স¤্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও  এ কথা সত্য যে, দেড় শতাব্দীর পরও সেই খেদোক্তির পুরো অবসান ঘটেনি। প্রসঙ্গটি বেশি জটিল এবং ঘোলাটে হয় তখনই, বাঙালি জাতিসত্তার শিকড় যখন কেউ অনুসন্ধান করতে যান। আমাদের বাঙালিদের উদ্ভব ও বিকাশের পরম্পরাগত ঐক্যসূত্র নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। প-িতদের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদেরও ইয়াত্তা নেই।

এই নিবন্ধ বাঙালি জনগোষ্ঠীর অতীত দেখার প্রয়াস মাত্র। নরতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক এবং ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির কিছু বিচ্ছিন্ন প্রসঙ্গে ‘প্রতœ বাঙালি’ (চৎড়ঃড়-ইধহমধষর) থেকে বাঙালি হয়ে ওঠার বিষয়ে একটি সাধারণ আলোচনা। নিবন্ধে ঘুরে ফিরে ওই কথা, দক্ষিণ এশিয়ার বাংলা ভাষাভাষী এই অঞ্চলে জাতি হিসাবে বাঙালিরা কখন থেকে কিভাবে বেড়ে উঠেছে। বাংলা নামে অভিহিত ভূ-খ-টির অতীতে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। আলাদা রাজনৈতিক পরিচয়ও ছিল। কিন্তু তা দীর্ঘকালের বিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগুতে এগুতে অসংখ্য বৈশিষ্ট্যের ও উপাদানের অধিকারী হয়। কত যে পালাবদলের খেলা চলেছে এখানকার জনজীবনের ইতিহাসে তার বিশদ বর্ণনা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

বাংলায় মানব বসতির সঠিক সময় আজও জানা সম্ভব হয়নি। ধ্রুপদী সাহিত্য ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণে’ বলা হয়েছে, পূর্ব ভারতে যে কটি ‘দস্যুকোম’ ছিল তার একটি হলো ‘পু-কোম’ (বর্তমানে বগুড়া জেলার মহাস্থানগড় অঞ্চল)। অপরদিকে ‘ঐতরেয় আরণ্যক’- এ উল্লেখ করা হয়েছে বঙ্গের। এই গ্রন্থ মতে, বঙ্গের অধিবাসীরা পাখির ভাষায় কথা বলত। আর্য ঋষিরা আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন এরা ছিল ভ্রষ্ট, অনাচারী, স্লেচ্ছ, দাস, দস্যু, লিঙ্গ উপাসক, নিষ্ঠাহীন, ভিন্ন ধর্মাসক্ত, অদীক্ষিত, অবৈদিক ভাষী এবং দেবতা ও বৈদিক কর্মবিরোধী ছিল, নৃতাত্ত্বিক আলোচনায় পু-্র ও বঙ্গের এসব আদি অধিবাসীরা। মোটামুটি একটি পরিচয় মিলে। বাংলা অঞ্চল আর্যায়িত হয় এখন থেকে মাত্র সাড়ে তিন হাজার আগে, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে। তখন থেকে আর্যভাষী আদি নর্ডিক জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে আগমন করেন। কিন্তু তার বেশ কয়েক হাজার পূর্বে নব্যপ্রস্তর যুগেই কিন্তু এই ভূ-খ-টি মানবগোষ্ঠীর অবস্থানের প্রমাণ মিলে। এদের ছিল দীর্ঘ মু-ু, দীর্ঘ ও মধ্যোন্নত নাস। দেহ ছিল বলিষ্ঠ এবং দৃঢ়বদ্ধ। ‘কোলিড’ বা আদি অষ্ট্রেলীয় এবং এ্যালপাইন জনের মানুষ ছিল এরা। যদিও এর সঙ্গে খানিকটা মিশেল ছিল নিগ্রিটো (নিগ্রবুট) ও মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর রক্তের। বেশ কয়েক হাজার বছর ধরে চড়াই-উৎরাই আর ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বিশেষ করে দীর্ঘমু-র আদি অষ্ট্রেলীয়, গোলমু-র এ্যালপো-দীনারীয় এবং খানিকটা উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় প্রদেশের আদি ‘নর্ডিক’ জন¯্রােতের ধারায় বাঙালি জনের উন্মেষ ঘটতে থাকে দীর্ঘকাল পরম্পরায়। প্রতœ বাঙালিত্বের এই পর্বের সমাপ্তি হয় খ্রিস্ট্রিয় নবম-দশম শতকে, যখন স্বতন্ত্র বাঙালি সত্তার অধিকারী ঐ জনগোষ্ঠী ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তার অব্যুদয়ের পরিচয়কে উপস্থাপন করতে সমর্থ হয়। আত্মশ্লাঘী হবার একটা প্রেরণাও তখন থেকে ভিতরে ভিতরে কাজ করতে শুরু করে তাদের মধ্যে।

সন্ধিক্ষণ পেরিয়ে পূর্ণাঙ্গ বাঙালিত্বে উত্তরণের প্রক্রিয়াও ঘটে আঞ্চলিক পর্যায়ে ও প্রকৃতির নানা কার্যাকারণকে অবলম্বন করে। আর্যবর্জিত বঙ্গ সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যের সঙ্গে কখনই তেমন আত্মীয়তা গড়ে তোলেনি। অথচ বঙ্গে শিক্ষা-দীক্ষা এবং জ্ঞান চর্চার নিজস্ব একটা পরিমন্ডল গড়ে উঠেছিল। যার সঙ্গে সর্বভারতীয় বৈশিষ্ট্যের কোন যোগসাজশ ছিল না, প্রভাব তো ছিলই না। বাঙালির এই স্বাতন্ত্রবোধের কথা বর্ণনা করেছে সপ্তম শতাব্দীর চীনা পরিব্রাজক বাঙালির জ্ঞান চর্চায় ও জ্ঞান স্পৃহার প্রমাণ মিলে যখন বাঙালি প-িত শীলভদ্র বিশ্বশ্রুত কীর্তির জন্য বিহারের নালন্দা মহাবিহারে আচার্যের পদ অলঙ্কৃত করেন। হিউয়েন সাঙ আরও লিখেছেন সে সময় বাঙালিরা বৌদ্ধ, নির্গ্রন্থ ও ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা-দীক্ষার পাশাপাশি ব্যাকরণ, শব্দবিদ্যা, হেতুবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, সংখ্যাতত্ত্ব, সঙ্গীত, মহাযানশাস্ত্র, অস্টাদশ নিকায়বাদ, যোগশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে অভিজ্ঞ ছিলেন। একেবারে পুরোপুরিভাবে বাংলায় এসব বিষয়ে খানিকটা চর্চা হয় খ্রিস্টীয় নবম-দশম (?) শতকে পাল শাসনামলে যখান মাগধী অপভ্রংশের গৌড়-বঙ্গীয় রূপ গড়ে উঠে। একটি কথা এখানে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় যে, ভাষা হিসাবে বাংলার উত্তরণের কাজ ত্বরাণি¦ত করতে বাংলার রাজশক্তির অবদান অবশ্যই ছিল। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী শাসকরা চেয়েছিলেন ধর্মতত্ত্বকথা জনগণের কাছে পোঁছাতে হলে লোকায়ত ভাষা বাংলায়ই সহজতর হবে। চর্যাগীতিই সেই লোকায়ত ভাষার সৃজ্যমান বাংলার প্রাচীনতম পরিচয়। এই সময় বাংলা ভাষা সূক্ষ্ম ও সুগভীর ভাবপ্রকাশের ক্ষমতা অর্জন না করলেও ধর্মের তত্ত্বকথা ধারণ ও উপস্থাপনের যোগ্যতা লাভ করে। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম দলিল চর্যাগীতিকার মূল্য বাঙালির কাছে অনেক। এর মধ্যে দিয়েই বাঙালি প্রথম এবং স্বতন্ত্রভাবে তার মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা লাভ করে। বলতে কী, চর্যার যে ছন্দ তাও কিন্তু এসেছে ‘সদানীরা’ অর্থাৎ জলময় পরিবেশের লোকায়ত লাচাড়ি ছন্দ থেকে। নদী, নৌকা ও মানুষ নিয়ে অসাধারণ বাংলার প্রকৃতি এই গীতিকায় ঘুরেফিরে এসেছে। চর্যাগীতিকার মতো সমসাময়িক কালের পোড়ামাটির ভাষ্কর্যের বাঙালির জীবনপ্রবাহ ধরা পড়ে। দৈনন্দিন জীবন নানাভাবে সেখানে উপস্থিত। কথা-কাহিনী থাকলেও পোড়ামাটির সেই শিল্পে কোন গভীর ভাব-রহস্য নেই, নেই বিস্তৃত কোন তত্ত্ব কিংবা আদর্শ। বাংলার চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছিল।  বাঙালির সমাজ সংস্থা সর্বোপরি যে স্বতন্ত্র জীবনচর্যা গড়ে উঠেছিল, শিল্পকলায়ও তার দৃষ্টান্ত মিলে। বাঙালির ভাষ্কর্য শিল্পের প্রকাশ ভঙ্গিমায় অন্তর্লোকের কোন গভীর চিন্তা বা ভাবে অভিব্যক্তি নেই, মুখাবয়ব স্থূল ও অমার্জিত, দাঁড়াবার ভঙ্গিও আড়ষ্টপূর্ণ। কিন্তু অবাক হতে হয়, এসব শিল্পে রয়েছে অসাধারণ প্রাণের প্রাচুর্য। বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাসে এই আঞ্চলিক রূপ ও রীতি ধরা পড়ে পাল আমলের তালপাতার অলঙ্করণদ্দেশে আঁকা চিত্রশিল্পে। সমসাময়িক কালের বাংলার সামাজিক অবস্থারই চিত্রায়ন এই চিত্রশিল্প।

সেই সময়ের বিশাল ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গ তো একটি জনপদ বিশেষ। সামন্ত রাষ্ট্রের চেতনায় লালিত হয়ে আঞ্চলিক মনোবৃত্তির যোগ্যতা অর্জন করেছে মাত্র, যা কেবলমাত্র জীবনবোধ ও মনমানসিকতাই নয়, ভাষা-সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। একটি জাতির পরিপূর্ণ অভ্যুদয়ের মধ্যে দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটে। প্রতœ বাঙালি পর্ব থেকে এখানকার জনগোষ্ঠী এ সময়ই বাঙালি হয়ে উঠে। চর্যার কবি ভুসুকুপা সর্বস্ব খুইয়ে বাঙালি হলেন, ‘আজি ভুসুকু বাঙ্গালি ভইলী’। ভুসুকুপার কথাটি যদি এভাবে নিই, তিনি পদ্মাপাড়ের জলদস্যুর দুস্যুবৃত্তির কারণে সর্বস্ব খুইয়ে চ-ালীনি স্বদেশভূমির কাছে আত্মনিবেদন করে। ভুসুকুপার বাঙালিদের পুরোপুরি বাঙালি হয়ে উঠতে আরও কয়েক শ’বছর সময় লেগেছে। খ্রিস্ট্রিয় চতুর্দশ শতকে ইলিয়াস শাহের ‘শাহ-ই-বাঙালিয়ান’ই বাঙালি হিসাবে নিজেকে উপস্থাপনের প্রথম প্রয়াস। ইতিহাসের এই অভিজ্ঞান কোনক্রমেই বিস্মৃত হওয়া চলবে না আমাদের।

লেখক পরিচিতি:
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী
গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

E-mail: Pr_saif@yahoo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.