বাণিজ্যিক রূপ নিয়েছে ঢাকা শিশু হাসপাতাল
আয়নাল হোসেন |
শিশুদের বিশেষায়িত সেবা দিতে স্থাপিত হয় ঢাকা শিশু হাসপাতাল। সরকারি সহায়তা ছাড়াও দেশী ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুদানের অর্থে পরিচালিত হচ্ছে দেশের একমাত্র শিশু হাসপাতালটি। রয়েছে ব্যক্তিপর্যায়ের অনেক সহায়তাও। হাসপাতালটির নির্মাণকালেও কনসার্ট আয়োজন ও গণচাঁদার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। দরিদ্র শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয় হাসপাতালটি। কিন্তু এ লক্ষ্য থেকে গেছে কাগজে-কলমেই। বাস্তবে অন্যান্য বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মতোই বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে হাসপাতালটি। বিভিন্ন সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে উচ্চহারে অর্থ আদায় করা হচ্ছে রোগীদের কাছ থেকে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মানিকগঞ্জের সদর উপজেলার লেবুবাড়ী এলাকার কৃষিশ্রমিক আবদুল আলীমের চার বছরের শিশুসন্তান আবদুল আহাদকে পায়ের চিকিত্সার জন্য ভর্তি করা হয় ঢাকা শিশু হাসপাতালে। কিন্তু অত্যধিক বেড ভাড়ার কারণে বিপাকে পড়তে হয় আহাদের পরিবারকে। আহাদের নানি মিমি বেগম বলেন, ‘গ্রাম থেকে ধারদেনা করে কিছু টাকা নিয়া ঢাকায় আইছিলাম। বেড ভাড়ায় সব টাকা শেষ। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধের খরচ তো দূরের কথা, খাওয়ার টাকাই নাই এহন।’
শুধু বেড ভাড়ার অত্যধিক হারই নয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফিও অন্যান্য বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মতো উচ্চহারেই আদায় করা হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে একটি ইকোকার্ডিওগ্রাফি করাতে মাত্র ২০০ টাকা ব্যয় হলেও শিশু হাসপাতালে লাগে ১ থেকে দেড় হাজার টাকা। বুকের এক্স-রে সরকারি হাসপাতালে ২০০ টাকার বিপরীতে শিশু হাসপাতালে ৩৫০ টাকা। সরকারি হাসপাতালে আলট্রাসনোগ্রামের ফি ১১০-২২০ টাকা। অথচ শিশু হাসপাতালে এজন্য নেয়া হয় ৬০০ টাকা। এভাবে সব ধরনের সেবার ক্ষেত্রেই আগতদের বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে।
অথচ হাসপাতালের নিজস্ব প্রকাশনায় বলা হয়েছে, দরিদ্র রোগীদের সেবার উদ্দেশ্যে আন্তঃবিভাগে ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ শয্যা বিনামূল্যে রাখা হয়েছে। এসব শয্যার রোগীরা বিনামূল্যে চিকিত্সা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও খাবার পাবেন। একই সঙ্গে রোগীর মায়েদেরও বিনামূল্যে খাবার সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি এন্টিবায়োটিকসহ প্রয়োজনীয় সব ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহের কথা বলা হয় প্রকাশনায়। কিন্তু এসবের অস্তিত্ব কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে নেই।
চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার রিকশাচালক ফয়সালের ১১ দিনের শিশু খাদিজাকে শিশু হাসপাতালের ৪ নং ওয়ার্ডের ৩৭ নম্বর শয্যায় ভর্তি করা হয়েছে। জন্মের পর থেকেই শিশুটি হূদরোগে আক্রান্ত। চিকিত্সকরা তার ইকোকার্ডিওগ্রাফি করতে বলেন। খাদিজার নানি কুলসুম বেগম হাসপাতাল কাউন্টারে ইকো পরীক্ষার ১ হাজার টাকা জমা দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাকে কাউন্টারে উপস্থিত বিভিন্ন জনের কাছে অর্থ সাহায্য চাইতে দেখা গেছে। বিছানা ও খাবার বিনামূল্যে পাওয়া গেলেও অন্যান্য সবই এখানে কিনতে হয় বলে জানান কুলসুম বেগম।
একই তথ্য জানালেন হাসপাতালের ৫ নং ওয়ার্ডের ৪৬ নম্বর শয্যায় ভর্তি ১৪ দিন বয়সের রাবেয়ার মা খুদিজা আক্তারও। তিনি জানান, এখানে অতিরিক্ত টাকা ছাড়া সেবা পাওয়া কঠিন। ফ্রি শয্যা ও খাবারও এখানে সবাই পায় না। রাজধানীর মিরপুরের ভ্যানচালক আনিসুর রহমান তার পাঁচ বছর বয়সী শিশু আয়েশাকে নিয়ে এসেছেন ঢাকা শিশু হাসপাতালে। বহির্বিভাগে ৩০ টাকার বিনিময়ে চিকিত্সক দেখানোর পর তাকে ভর্তির সুপারিশ করা হয়। দৈনিক শয্যা ভাড়া ৬০০ টাকা চাওয়া হয় তার কাছে। এ অবস্থায় ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচের কথা চিন্তা করে তিনি শিশুটিকে ভর্তি না করেই ফিরে যান।
হাসপাতালের বিনামূল্যের শয্যায় ভর্তিকৃত রোগীর স্বজনরা শুধু শয্যা ও খাবার ছাড়া সবই টাকার বিনিময়ে পেয়ে থাকেন। বিষয়টি নিয়ে হাসপাতালের সিনিয়র জনসংযোগ কর্মকর্তা আবদুল করিমের মুখোমুখি হলে তিনি তা মানতে অস্বীকৃতি জানান। পরে তাকে নিয়ে অভিযোগকারীদের মুখোমুখি হলে তিনি বলেন, ‘কিছু পরীক্ষা করাতে টাকা লাগে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। একই পরীক্ষায় সরকারি হাসপাতালের চেয়ে অত্যধিক বেশি রাখা হয় কেন— জানতে চাইলে আবদুল করিম বলেন, ‘আমরা মেশিন ও কার্ডিওগ্রাফির সবকিছুই টাকা দিয়ে কিনে ব্যবহার করি। কিন্তু সরকারি হাসপাতাল মেশিন ও অন্যান্য সরঞ্জাম বিনামূল্যে পেয়ে থাকে, যা আমরা পাই না।’ তিনি এ সময় নিজেদের সেবার মান অন্যদের চেয়ে উন্নত বলেও দাবি করেন।
অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ হাসপাতালকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের অসংখ্য ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান অনুদান দিয়ে আসছে। জমি ও ভবন বরাদ্দের পাশাপাশি সরকার প্রতি বছর ১৪ থেকে সাড়ে ১৪ কোটি টাকা অনুদান দিয়ে আসছে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর মধ্যে জাইকা, ফুড ফর দ্য হাংরি ইন্টারন্যাশনাল, আইসিডিডিআর’বি, ইউএসএআইডি, কুয়েত, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া দূতাবাস, অস্ট্রেলিয়া অ্যাপেক্স ক্লাব, ন্যাশনাল ওম্যান’স ফেডারেশন, কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি, সার্ক, উইমেন’স ফেডারেশন ও ইনার হুইল ক্লাব অন্যতম।
ঢাকা শিশু হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, শিশুর স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ১৯৭২ সালের মার্চে প্রতিষ্ঠা হয় দেশের একমাত্র এ শিশু হাসপাতাল। কিছু স্বেচ্ছাসেবক ও ব্যক্তির সহযোগিতায় রাজধানীর ধানমণ্ডির একটি ভাড়া বাড়িতে ৫০ শয্যা নিয়ে যাত্রা করে হাসপাতালটি। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের সভায় ২৫০ শয্যার শিশু হাসপাতাল প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। পরের বছরের মার্চে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শেরেবাংলানগরে হাসপাতালটি স্থানান্তর করে। এর পর ১৯৭৭ সালে হাসপাতালটি বর্তমান অবস্থানে কার্যক্রম শুরু করে। হাসপাতালটির সম্প্রসারণে ভবন নির্মাণের ব্যয় বহন করে সরকার ও ঢাকা শিশু হাসপাতাল ট্রাস্ট। আর ট্রাস্ট অর্থ সংগ্রহ করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনুদান এবং দুটি লটারি ও একটি কনসার্টে তোলা গণচাঁদার মাধ্যমে।
বর্তমানে হাসপাতালটি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, যার শয্যা সংখ্যা ৬৪০। দৈনিক ৮০০-৯০০ রোগী আসে বহির্বিভাগে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে হাসপাতালটির বহির্বিভাগে রোগী এসেছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩০৯ জন। এ সময়ে ভর্তি করা হয়েছে ৩৮ হাজার ২২১ জন রোগীকে।
ভর্তি রোগীর বিপরীতে বিনামূল্যের শয্যার রোগীদের প্রতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলাও দৃশ্যমান। সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের ভাড়ার শয্যাগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কিন্তু বিনামূল্যের ওয়ার্ডের চেহারা খুবই নাজুক। শয্যা থেকে শুরু করে চাদর, আসবাবপত্র ও দেয়াল সবকিছুতেই অযত্নের ছাপ সুস্পষ্ট। স্বাস্থ্যসেবা নিতে এসে এক রকম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই থাকতে হয় রোগীদের।
জানতে চাইলে হাসপাতালটির পরিচালনা ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক ডা. সারফুদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, হাসপাতাল পরিচালনার নিয়ম অনুযায়ী বিনামূল্যের শয্যায় ভর্তিকৃত রোগীরা সব ধরনের সেবা বিনামূল্যে পাবে। সেটি না পেয়ে থাকলে আগামী বোর্ডসভায় বিষয়টি উত্থাপন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেনের কক্ষে গেলে তার ব্যক্তিগত সহকারী জানান, তিনি হাসপাতালের বাইরে একটি মিটিংয়ে রয়েছেন। তার মোবাইল নাম্বার চাইলে তিনি তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তার কাছেও পরিচালকের মোবাইল নাম্বার পাওয়া যায়নি। পরে অন্য মাধ্যমে তা সংগ্রহ করে ডা. মনজুরের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।সূত্র: বণিক বার্তা।