বিশ্বব্যাপী মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট – ড. মনজুর হোসেন
বিশ্বের অনেক দেশ সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে বা ঘটাতে বাধ্য হয়েছে। গত আগস্টে চীন তার মুদ্রার বড় (প্রায় ৩ শতাংশ) ধরনের অবমূল্যায়ন ঘটানোর পর বিশ্বে এ নিয়ে হইচই শুরু হয়। চীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অনেক দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তাই দেশটির মুদ্রার অবমূল্যায়ন অনেক দেশের জন্যই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ এতে প্রতিযোগিতায় চীনের সঙ্গে পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়। ফলে বেশকিছু দেশ তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে। এর মধ্যে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া, লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ অন্যতম। এ ধরনের অবমূল্যায়নকে প্রতিযোগিতামূলক অবমূল্যায়ন বলা হয়। এ ধরনের অবমূল্যায়নের উদ্দেশ্য, নিজ দেশের রফতানি বাড়ানো এবং আমদানি সীমিতকরণ। কারণ মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে সাধারণত ওই দেশের পণ্য সস্তায় বিদেশে বিক্রি করা যায়। চীনের অবমূল্যায়নের আগে জাপানের ইয়েনের এবং ইউরোর অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। এ অবস্থায় অনেক অর্থনীতিবিদ আশঙ্কা করছেন, এ ধরনের প্রতিযোগিতামূলক অবমূল্যায়ন বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা ডেকে আনতে পারে। কারণ সব দেশই যদি রফতানি বাড়াতে আর আমদানি কমাতে চায়, তাহলে বিশ্ববাণিজ্য তথা বিশ্বে আমদানি ও রফতানি দুই-ই কমে যাবে এবং অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে। বিশ্ববাণিজ্যকে এককভাবে চিন্তা করলে তাতে মোট আমদানি ও রফতানির পরিমাণ সমান হওয়ার কথা। এ ধরনের প্রতিযোগিতা চলতে থাকলে আমদানি ও রফতানি দুটোই কমে যাবে এবং বিশ্বমন্দা সৃষ্টি হবে। তবে আশার কথা হলো, অবস্থা এখনো ততটা খারাপের দিকে যায়নি। এখনো অনেক দেশ মুদ্রা অবমূল্যায়নের পথে না হেঁটে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতিতে গতিশীলতা আনার চেষ্টা করছে তাদের নিজস্ব অর্থনীতির দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য।
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বড় রফতানি খাত পোশাক শিল্পের মালিকরা বাংলাদেশী টাকার আরো অবমূল্যায়ন চাইছেন। এমনকি তারা একটি ভিন্ন মুদ্রা বিনিময় হার (অবশ্য অবমূল্যায়িত) চাইছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এ চাওয়া কতটুকু যৌক্তিক? প্রায় এক বছর ধরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে ইউরোর অবমূল্যায়নে পোশাক রফতানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইউরোজোনে বাংলাদেশের রফতানিমূল্য মূলত মার্কিন ডলারে পরিশোধ করা হয়। ফলে ইউরোর বিপরীতে ডলার শক্তিশালী হওয়ায় ইউরোপীয় ক্রেতারা বাংলাদেশী পোশাকের মূল্য কমানোর জন্য চাপ দিচ্ছেন এবং তা রফতানিকারকরা অনেক ক্ষেত্রে মেনে নিচ্ছেন মূলত বাজার ধরে রাখতে। ফলে ইউরোপীয় বাজার থেকে রফতানিকারকরা আগের চেয়ে কম ডলার আয় করছেন। তাদের আয়কে আগের অবস্থায় রাখতে হলে একটি উপায় হতে পারে ডলারের বিনিময়ে টাকার অবমূল্যায়ন করা। এছাড়া বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রারও অবমূল্যায়নের ফলে রফতানিকারকদের পক্ষ থেকে টাকার অবমূল্যায়নের দাবিটি জোরালো হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য বিবেচনায় টাকা অবমূল্যায়নের কতটুকু সুযোগ আছে? টাকার অবমূল্যায়ন ছাড়া আর কোনো বিকল্প রয়েছে কিনা?
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের টাকা আগে থেকেই অবমূল্যায়িত। এখানে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার দুই বছর যাবৎ স্থিতিশীল রয়েছে। মুদ্রা বিনিময়ের এ হার ৭৭-৭৮ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। সামষ্টিক অর্থনীতির আলোকে অর্থাৎ ডলারের চাহিদা ও জোগানের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান হারটি বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার বাজার থেকে বিশাল পরিমাণ ডলার ক্রয়ের মাধ্যমে হারটি কৃত্রিমভাবে বজায় রেখেছে। ধারণা করা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে হস্তক্ষেপ না করলে এবং চাহিদা-জোগানের ভিত্তিতে টাকা-ডলার বিনিময় হার নির্ধারিত হলে এ হার সম্ভবত ৭০ টাকার কাছাকাছি থাকত। এ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই একটি অবমূল্যায়িত মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীলতার সঙ্গে বজায় রাখছিল, যার সুফল রফতানিকারকরা পেয়ে আসছিলেন। অন্যদিকে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটালে রফতানিকারকরা সুবিধা পেলেও আমদানিকারকরা অসুবিধার সম্মুখীন হন। তাদের বেশি দামে পণ্য আমদানি করতে হয়। ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর এর প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায়ও কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়। যেমন— বাজার থেকে ডলার কেনার ফলে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সহায়তা করলেও ডলার কেনার বিপরীতে যে পরিমাণ টাকা বাজারে চলে যায়, তা আবার বাজার থেকে তুলে আনতে না পারলে (যাকে অর্থনীতির ভাষায় স্টেরিলাইজেশন বলা হয়) এটি মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি বাড়াতে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদিওবা বলছে, তারা যে পরিমাণ ডলার বাজার থেকে ক্রয় করে তা পুরোপুরিই বন্ডের মাধ্যমে স্টেরিলাইজ করে থাকে। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর তেমন প্রভাব পড়ে না। পুরোপুরি স্টেরিলাইজেশন হয় কিনা যদিও এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই, তবুও বলা যায়, বন্ডের মাধ্যমে স্টেরিলাইজেশন করলেও তার ওপর সুদ পরিশোধ করতে হয়। ফলে এ প্রক্রিয়াও ব্যয়বহুল। এছাড়া এতে মুদ্রা সরবরাহ সঙ্গে সঙ্গে না বাড়লেও কিছু সময় পরে বাড়ে, যার প্রভাব মূল্যস্ফীতির ওপর পড়ে থাকবে। মোদ্দাকথা হলো, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটালে তার ধনাত্মক ও ঋণাত্মক দুই ধরনের প্রভাব অর্থনীতির ওপর রয়েছে এবং এর নিট প্রভাবের ওপর নির্ভর করে অর্থনীতি এ থেকে কতটুকু সুফল পাচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনীতির সম্পর্ক বোঝার জন্য রিয়াল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট (REER) গতিবিধি দেখা হয়। REER নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রধান প্রধান বাণিজ্য অংশীদারের মুদ্রা বিনিময় হারের সঙ্গে তাদের মূল্যস্ফীতি ও বাণিজ্যের পরিমাণকে বিবেচনায় নেয়া হয়। REER অতিমূল্যায়নের দিকে যেতে থাকলে বুঝতে হবে যে, মুদ্রা বিনিময় হারের ব্যবস্থাপনার কারণে দেশটির বাণিজ্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। কারণ আপেক্ষিক মূল্য বা Relative price। ফলে ওই দেশের পণ্যবাণিজ্য অংশীদারদের পণ্যের চেয়ে ব্যয়বহুল হতে থাকবে। বাংলাদেশের ডলারের বিপরীতে মুদ্রা বিনিময় হার গত কয়েক বছর স্থিতিশীল থাকলেও মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে REER অনেকটাই অতিমূল্যায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্ট ২০১৪-এ দেখা যায়, REER প্রায় ১৭ শতাংশ অতিমূল্যায়িত হয়েছে এক বছরে। এর অর্থ হলো, মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বাণিজ্য অংশীদারদের চেয়ে বেশি হওয়ায় REER-এর অতিমূল্যায়ন হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা। অথচ আমাদের রফতানিকারকরা ডলারের বিপরীতে টাকার আরো অবমূল্যায়ন চাইছেন। কেন? বিষয়টি কিছুটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করলেও তার উত্তর দেয়া সম্ভব।
বাংলাদেশের রফতানির প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশ হচ্ছে পোশাক খাত। এ খাত সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। যেমন— দেশে নগদ ভর্তুকি, স্বল্প সুদে রফতানি ঋণ, রফতানির একটি অংশ বিদেশে রেখে তার সুবিধা নেয়া, আন্তর্জাতিক বাজারে জিএসপি (বর্তমানে ইউরোপের বাজারে সীমাবদ্ধ) এবং সর্বোপরি কম মজুরিতে শ্রমিক। এসব সুবিধার কারণেই মূল্যস্ফীতিজনিত অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারকরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে আছেন। এ থেকে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের বাণিজ্যের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে REER তেমন ভালো নির্দেশক নয়। এটা ঠিক, রফতানি যদি একটি নির্দিষ্ট খাত বা পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় এবং পণ্য বা খাতটি যদি বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকতা পায় তাহলে REER-এর গতিবিধি দ্বারা বাণিজ্য প্রতিযোগিতা নির্ণয় করা কঠিন। এ অবস্থায় শুধু বাণিজ্য ভার দিয়ে নির্ণীত নমিনাল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট (NEER) একটি ভালো সূচক হিসেবে কাজ করতে পারে। উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, NEER বছর খানেক ধরে স্থিতিশীল থাকলেও বর্তমানে কিছুটা অতিমূল্যায়িত রয়েছে (৫-৭%); যা মূলত বাণিজ্য অংশীদারদের মুদ্রার অবমূল্যায়নের সঙ্গে টাকার সামঞ্জস্যের অভাবের কারণে হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, রফতানিকারকরা প্রতিযোগিতামূলক অবমূল্যায়নের কারণে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে টাকার কিছুটা অবমূল্যায়ন ঘটালে NEER ভারসাম্য অবস্থায় ফিরে আসবে এবং রফতানিকারকরা সুবিধা পাবেন।
আলোচনায় এ বিষয় মূলত পরিষ্কার হয়েছে যে, বড় বড় মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে রফতানিকারকরা প্রতিযোগিতায় কিছুটা পিছিয়ে আছেন এবং টাকার অবমূল্যায়নের জন্য তাদের যে দাবি, তার যৌক্তিকতা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে এ বিষয়ও উল্লেখ্য, পোশাক রফতানি খাত বর্তমান পরিস্থিতির আগে থেকেই অবমূল্যায়িত টাকার সুবিধা পেয়ে আসছিল। তাছাড়া তারা অন্য অনেক ধরনের (non-price) সুবিধা ভোগ করে আসছেন। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য মুদ্রা অবমূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কয়েকটি বিষয়ে ভাবতে হবে। টাকার আরো অবমূল্যায়ন ঘটালে REER আরো অতিমূল্যায়িত হতে থাকবে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। অন্যান্য রফতানি খাত এতে অসুবিধার সম্মুখীন হবে। এতে মূল্যস্ফীতি কমানোর বর্তমান প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হবে এবং এ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি আরো সংকোচনমূলক করলে তা কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এসব বিবেচনায় নিয়ে, বিশেষ করে বাণিজ্য অংশীদারদের প্রতিযোগিতামূলক অবমূল্যায়নের ফলে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর এর কী প্রভাব, সে বিষয়ে আরো গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। তবে যেহেতু বর্তমানে আমদানি প্রবৃদ্ধি শ্লথ এবং মূল্যস্ফীতি অনেকটাই লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রয়েছে, এ পরিপ্রেক্ষিতে টাকার কিছুটা অবমূল্যায়ন ঘটালে তা সামগ্রিকভাবে সুফল বয়ে আনতে পারে বলে মনে হয়। তবে কাজটি করার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনাটি আরো গতিশীল কাঠামোয় আনা প্রয়োজন, যাতে করে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তারা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে পারেন।
লেখক: বিআইডিএসের সিনিয়র গবেষক বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার বিশেষজ্ঞ
monzur@bids.org.bd