বৃষ্টিতে নষ্ট সড়ক-মহাসড়কে ভোগান্তির আশঙ্কা

২০০ কোটি টাকা ব্যয়ের সুফল নেই

বৃষ্টিতে নষ্ট সড়কমহাসড়কে ভোগান্তির আশঙ্কা

 

ঈদের আগে সড়ক-মহাসড়ক মেরামতে জরুরি বরাদ্দ ২০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর। এ অর্থে কিছু সড়ক মেরামত করা হয়। তবে গত শনিবার শুরু হওয়া বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অস্থায়ী এসব মেরামত। গতকালের ভারি বর্ষণে বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে আবারো খানাখন্দ দেখা দিয়েছে। এতে ঈদের এ ব্যস্ত সময়ে ধীরে চলছে যানবাহন আর তৈরি হচ্ছে যানজট। ফলে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ের সুফল তো মিলছেই না, উল্টো ঈদযাত্রায় ভোগান্তির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

সওজের তথ্যমতে, সারা দেশে বর্তমানে প্রায় ১৪ শতাংশ বা তিন হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে। এসব সড়ক-মহাসড়ক মেরামতে তাত্ক্ষণিকভাবে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে দুদিনের বৃষ্টিতে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কসহ বিভিন্ন আন্তঃজেলা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ঈদের আগেই মহাসড়কগুলোয় যানজট শুরু হয়ে গেছে।

কুমিল্লার দাউদকান্দিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বেশকিছু অংশজুড়ে খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। মহাসড়কের ওই স্থানটিতে পিচ উঠে ইট বের হয়ে গেছে। সেখানে যানবাহন চলাচল করছে ঝুঁকি নিয়ে। এসব যানবাহনের গতি কমে যাওয়ায় কয়েক দিন ধরে যানজট হচ্ছে। ফলে মহাসড়কে চার লেনের কাজ হয়ে গেলেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বরং মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল প্লাজা এলাকা থেকে বিশ্বরোড পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার এলাকায় শনিবার মধ্যরাত থেকে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।

গতকালই যানজট সৃষ্টি হয় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে। প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটে আটকা পড়ে কয়েকশ যানবাহন। পণ্য ও পশুবাহী যানবাহনের পাশাপাশি আটকা পড়ে অসংখ্য যাত্রী; যাদের মধ্যে আগেভাগে ঘরে ফিরতে ইচ্ছুক মানুষের সংখ্যাই বেশি।

সূত্র জানায়, সওজের বিভিন্ন জোনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত রয়েছে সিরাজগঞ্জে। এ জেলার ৪২৭ কিলোমিটারের মধ্যে ২০৯ কিলোমিটারই বর্ষায় বিপন্ন হয়েছে। এছাড়া বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে— চট্টগ্রাম, পাবনা, ভোলা, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজার ও রংপুর।

এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বণিক বার্তাকে বলেন, বৃষ্টিটা আমাদের জন্য এক ধরনের শিক্ষা। টানা বৃষ্টিতে কোন সড়ক ঠিক থাকছে আর কোনটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা দেখে বোঝা যাচ্ছে কাজের মান। একই সঙ্গে মেরামত করা হলেও আশুলিয়া সড়কে খানাখন্দ দেখা দিয়েছে; কিন্তু টঙ্গীর অংশ ঠিক আছে। এতে ঠিকাদারদের ফাঁকিবাজি চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছে। এজন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াও সহজ হবে। তবে ঈদের আগে সড়কগুলো যথাসম্ভব ঠিক রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, ঢাকায় গাড়ি প্রবেশ ও বের হওয়ার ক্ষেত্রে গাবতলীর যানজট এড়াতে সেতুর নিচে এক কিলোমিটার দীর্ঘ কংক্রিটের ইউলুপ সড়ক ঈদের আগে নির্মাণের সিদ্ধান্ত হলেও তা কার্যকর হয়নি। ওই ইউলুপ সড়ক নির্মাণ হলে ঢাকার সিটি সার্ভিসগুলো সেতুর নিচ দিয়ে ঘুরে আবার শহরে ঢোকার কথা ছিল। একইভাবে বাবুবাজার সড়কের গাড়িও যানজট এড়িয়ে সহজে চলাচলের সুযোগ পেত। এতে গাবতলী সেতু-সংলগ্ন সিগনালে ঢাকায় প্রবেশ ও বের হওয়ার গাড়িগুলো আটকা থাকত না। বাস্তবে দেখা গেছে, ইট-সুরকি দিয়ে ওই সড়ক জোড়াতালি দেয়া হয়েছে। এতে গাড়ি চলাচল করতে পারছে না।

এদিকে টাঙ্গাইল জেলাসহ উত্তরবঙ্গের বেশকিছু জেলার গাড়ি আবদুল্লাহপুর থেকে আশুলিয়া হয়ে যাতায়াত করে। শিল্প এলাকা হওয়ায় এ মহাসড়কে গাড়ির চাপ বেশি। মাত্র ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মহাসড়ক দীর্ঘদিন ধরে বেহাল অবস্থায় রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ইট-সুরকি দিয়ে সব মিলিয়ে এক কিলোমিটার এলাকা সংস্কারের মাধ্যমে সড়কটিতে যান চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একটু বৃষ্টিতেই রাস্তা নষ্ট হচ্ছে। আর বারবার দেয়া হচ্ছে জোড়াতালি।

টঙ্গী, ঘোড়াশাল, পাঁচদোনা হয়ে বেশকিছু গাড়ি সিলেট অঞ্চলে চলাচল করে। টঙ্গী থেকে পাঁচদোনা পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার সড়কের অবস্থাও ভালো নয়। অপ্রশস্ত এ সড়ক জোড়াতালি দিয়ে যান চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একইভাবে ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথে টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা এবং যাত্রাবাড়ী থেকে চিটাগং রোডের বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দ রয়েছে। ঈদ সামনে রেখে ভাঙাচোরা সড়ক-মহাসড়কে জোড়াতালির নানা রকম কসরত চলছে। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের উপকরণ। এ কারণে কিছু সময় গাড়ি চলতেই রাস্তা আবার ভেঙে আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে।

সওজের প্রধান প্রকৌশলী মো. ফিরোজ ইকবাল বলেন, বর্ষায় অনেক সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলো জরুরি মেরামত করা হলেও হঠাত্ বৃষ্টিতে তা ধুয়ে যাচ্ছে। তবে সড়কের সংস্কারকাজ বন্ধ নেই। বৃষ্টির পর পরই ইট-সুরকি দিয়ে অন্তত চলাচলের উপযুক্ত রাখা হচ্ছে।

প্রতি বছরই বর্ষা এলে সারা দেশের সড়ক বেহাল হয়ে পড়ে। সড়ক পরিবহন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বৃষ্টিতে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া স্বাভাবিক। তবে বেহাল হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে মেরামতে অপচয়-লুটপাট। তাদের মতে, দুই কারণে বর্ষা এলেই সড়ক বেহাল হয়ে পড়ে। প্রথমত. বেহাল সড়ক মেরামতের জন্য চাহিদা মেনে বরাদ্দ পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত. যে অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায়, তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা হয় না।

সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, প্রতি বছরই সওজের মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা (এইচডিএম) বিভাগ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে সড়কের অবস্থার ওপর প্রতিবেদন তৈরি করে। কোন সড়ক কীভাবে মেরামত করা দরকার এবং কী পরিমাণ ব্যয় হতে পারে, সে হিসাবও প্রস্তাব করে। সে হিসাবে দেখা গেছে, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা মেরামতে ব্যয় করার কথা বলা হয়। কিন্তু এ সময় এর অর্ধেকও বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।

সড়ক পরিবহন বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, কম বরাদ্দ পাওয়ার পরও এর একটা অংশ আবার বেহাত হয়ে যায় প্রকৌশলী-ঠিকাদারের যোগসাজশে। দৈনন্দিন মেরামতের একটা বড় অংশ ব্যয় করা হয় তাত্ক্ষণিক দরপত্রের মাধ্যমে। সওজের প্রতিটি জেলা পর্যায়ের কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারকে কাজ দেয়া হয়। এদের অনেকেই আবার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা। এসব ঠিকাদার অর্থবছরের শুরুতে কিছু কাজ করে ফেলে রাখেন। শেষের দিকে এসে তাড়াহুড়ো করলেও তা মানসম্মত হয় না। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই তা ধুয়ে যায়।                   বণিক বার্তা

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.