ব্যবসায় পরিবেশ ক্রমেই কঠিন হচ্ছে বাংলাদেশে
ব্যবসায় পরিবেশ ক্রমেই কঠিন হচ্ছে বাংলাদেশে
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান স্থাপনে জমি কিনলে তার নিবন্ধনে সময় লাগে ২৪৪ দিন। আর ওই জমিতে অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি পেতে লেগে যায় ২৬৯ দিন। এখানেই শেষ নয়, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুত্সংযোগ পেতে সময় লাগে আরো বেশি, গড়ে ৪২৯ দিন (এক বছর দুই মাসের বেশি)। আর এসব সেবার অনুমোদন প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগকারীদের ব্যয় করতে হয় কোটি টাকার বেশি।
এসব ঝামেলা পেরিয়ে ব্যবসা শুরু করেও মুক্তি নেই বিনিয়োগকারীদের। পণ্য আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়ায়ও পোহাতে হয় নানা জটিলতা। এর মধ্যে রফতানির নথিপত্র প্রক্রিয়াকরণে সময় লাগে ১৪৭ ঘণ্টা (ছয়দিনের বেশি)। এতে ব্যয় করতে হয় ৮৩০ ডলার। আর আমদানিতে ব্যয় করতে হয় ১ হাজার ৮৬১ ডলার; সময় লাগে ১৪৪ ঘণ্টা (ছয়দিন)। এর ওপর সড়কপথে পণ্য পরিবহনে সময়ের অপচয় তো আছেই। আমদানি-রফতানির পণ্য পরিবহনে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোর পেরোতে লেগে যায় প্রায় ২০ ঘণ্টা। আর বন্দরে আমদানিতে যায় ১৮৩ ঘণ্টা ও রফতানিতে ১০০ ঘণ্টা।
এটিই বাংলাদেশে ব্যবসায় পরিবেশের চিত্র, যা উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস ২০১৬’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। গত বছরের তুলনায় এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো উন্নতি হয়নি। বরং কিছু ক্ষেত্রে অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে। ফলে সহজে ব্যবসা করার সূচকে দুই ধাপ পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান করছে ১৭৪তম স্থানে। গত বছর এ অবস্থান ছিল ১৭২তম। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে সপ্তম।
২০১৫ সালের ১ জুন পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। ব্যবসা শুরু ও পরিচালনার ক্ষেত্রে নিয়মকানুন কতটুকু সহজ বা কঠিন, তার ভিত্তিতে প্রতি বছর এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। চলতি বছরের প্রতিবেদনটি গতকাল সারা বিশ্বে একযোগে প্রকাশ হয়।
উল্লেখ্য, সহজে ব্যবসা করার সূচকে কয়েক বছর ধরেই ধাপে ধাপে পেছাচ্ছে বাংলাদেশ। সাত বছর আগে ২০০৯ সালে সূচকটিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮৩টি দেশের মধ্যে ১১৫তম।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবসাবান্ধব প্রয়োজনীয় পরিবেশের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। চলতি বছর ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ৪৩ দশমিক ১০, গত বছর যা ছিল ৪২ দশমিক ৭১। পয়েন্টে সামান্য অগ্রগতি হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় তা কম। তাই সার্বিক সূচকে পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ।
ব্যবসায় পরিবেশকে ১০টি উপসূচকে বিন্যস্ত করে সেগুলোর অবস্থা বিশ্লেষণ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এগুলো হলো— ব্যবসায় শুরু, অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি, বিদ্যুতের প্রাপ্যতা, সম্পত্তি নিবন্ধন, ঋণ প্রাপ্যতা, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, কর পরিশোধ, বৈদেশিক বাণিজ্য, চুক্তির বাস্তবায়ন ও দেউলিয়া দশার সমাধান।
১০টি সূচকের কোনোটিতেই এ বছর উন্নতি করতে পারেনি বাংলাদেশ। এর মধ্যে পাঁচটি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। বাকি পাঁচটি সূচকে অবস্থান আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অবনতি হয়েছে ব্যবসায় শুরুর সূচকে। গত বছর এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১১। ছয় ধাপ পিছিয়ে এবার সূচকটিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৭তম। ঋণ প্রাপ্যতা সূচকে ১২৮ থেকে পাঁচ ধাপ পিছিয়ে এবারের অবস্থান ১৩৩তম। সম্পত্তি নিবন্ধন, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা ও কর পরিশোধ সূচকে গতবারের চেয়ে এক ধাপ করে পিছিয়েছে বাংলাদেশ। এ তিন সূচকে অবস্থান যথাক্রমে ১৮৫, ৮৮ ও ৮৬তম।
বিদ্যুত্সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। এ সূচকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮৯, এবারো তাই আছে। অর্থাৎ বিশ্বে সবার নিচে। এছাড়া অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতিতে ১১৮, বৈদেশিক বাণিজ্যে ১৭২, চুক্তির বাস্তবায়নে ১৮৮ ও দেউলিয়াত্ব নিষ্পত্তিতে ১৫৫তে রয়েছে বাংলাদেশ। এ চার সূচকে অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস থেকে জানানো হয়, পাশের দেশ ভারত ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে গত বছর দুটি বড় ধরনের সংস্কার কার্যক্রম সম্পাদন করেছে। ফলে দেশটি ১০ ধাপ এগিয়েছে। শ্রীলংকাও সংস্কার কার্যক্রমের জন্য এগিয়েছে। তবে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ কোনো ধরনের সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়নি। ফলে দেশগুলো পিছিয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বশেষ অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান। বিশ্বতালিকায় দেশটির অবস্থান ১৭৭তম। আর দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষস্থানে আছে ভুটান, অবস্থান ৭১তম। এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মধ্যে নেপালের অবস্থান ৯৯, শ্রীলংকার ১০৭, মালদ্বীপের ১২৮, ভারতের ১৩০ ও পাকিস্তানের ১৩৮তম।
সারা বিশ্বে ব্যবসা করার সূচকে শীর্ষে রয়েছে সিঙ্গাপুর। শীর্ষ পাঁচে এর পরই রয়েছে— নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও হংকং। শীর্ষ পাঁচটি দেশের স্কোরই ১০০তে ৮৩-এর উপরে। আর বিশ্বের ১৮৯টি দেশের মধ্যে সর্বশেষ পাঁচটি দেশ হলো— ইরিত্রিয়া, লাইবেরিয়া, দক্ষিণ সুদান, ভেনিজুয়েলা ও মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র। দেশগুলোর স্কোর ৩৬ বা তার নিচে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করতে কমপক্ষে নয়টি প্রক্রিয়া (প্রসিডিউর) অনুসরণ করতে হয়। এতে সময় লাগে প্রায় ২০ দিন। আর ব্যয় করতে হয় গড়ে ১২ হাজার ৬০৫ টাকা। তবে ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ১০০তে বাংলাদেশের স্কোর এক্ষেত্রে ৮১ দশমিক ৭২।
ব্যবসা স্থাপনের জন্য অবকাঠামো নির্মাণে অনুমতি গ্রহণে কমপক্ষে ১৩টি প্রক্রিয়া অনুসরণের প্রয়োজন হয়। এতে ব্যয় হয় গড়ে ৭৬ হাজার ৪০০ টাকা। ১০০-এর মধ্যে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৬৫ দশমিক ২৭। আর সম্পত্তি নিবন্ধনে প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয় আটটি। এতে সম্পত্তিমূল্যের ৭ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের চার্জ বাবদ পরিশোধ করতে হয়। এর পরও অতিরিক্ত ২৭ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয় হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ১০০-এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৪৮।
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো সহজে বিদ্যুত্সংযোগ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর মাত্র ১৫ দশমিক ৩১। কারণ বিদ্যুত্সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে কমপক্ষে নয়টি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। আর এতে ব্যয় করতে হয় গড়ে ২৯ লাখ ২৮ হাজার ৯২১ টাকা।
ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ১ শতাংশের কম ব্যয় হলেও রয়েছে নানা জটিলতা। বিশেষত সঠিক তথ্যের অভাব এক্ষেত্রে প্রকট। ফলে ১০০তে স্কোর দাঁড়িয়েছে ৩০। আর দেউলিয়া দশার সমাধানে মাত্র চার বছর সময় দেয়া হয়, যা নতুন বিনিয়োগকারীর জন্য খুবই কম। এক্ষেত্রে ১০০তে স্কোর ২৬ দশমিক ৩৬।
চুক্তি বাস্তবায়নে ১ হাজার ৪৪২ দিন (প্রায় চার বছর) সময় দেয়া হয়। এর পরও পাওনা টাকার এক-তৃতীয়াংশ আদায় করা যায় না। সব মিলিয়ে সার্বিক অবস্থা অসন্তোষজনক, যা স্কোরেও স্পষ্ট। ১০০তে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পেয়েছে ২২ দশমিক ২১। আর আমদানি-রফতানি সূচকে স্কোর ১০০তে ৩৪ দশমিক ৮৬। তবে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। একই অবস্থা কর পরিশোধ সূচকেও। এ দুই সূচকে স্কোর ১০০তে যথাক্রমে ৫৩ দশমিক ৩৩ ও ৭৪ দশমিক ৪২।
এ বিষয়ে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, এ প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রবৃদ্ধি চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামো উন্নয়ন করা। বাংলাদেশ সেটা করতে পারছে না। কিন্তু প্রতিযোগী অন্যসব দেশ বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে এ প্রতিবেদনে দুই ধাপ পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কিছু উন্নতি হয়েছে। তবে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত স্থিতিশীল নয়। অন্যান্য অবকাঠামোর উন্নয়নও খুব বেশি দৃশ্যমান নয়। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান জড়িত, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাড়াতে হবে বিনিয়োগও।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের দুটি শহর ঢাকা ও চট্টগ্রামের তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ঢাকার তথ্যের ওপর ৭৮ শতাংশ ও চট্টগ্রামের ওপর ২২ শতাংশ গুরুত্ব বা ভর (ওয়েট) দিয়ে গড় মান নির্ণয় করা হয়েছে।