ব্যাংকিং খাত – অনিয়ম সামলাতেই বছর পার

সাকিব তনু |

ঋণের চড়া সুদহার কিছুটা কমলেও গতি আসেনি বিতরণে। উল্টো ঋণ অনুমোদনে ঘটেছে অনিয়ম। বিদেশ থেকে নেয়া ঋণের অর্থ ব্যয় হয়েছে অনুমোদনহীন খাতে। আবার অনিয়মিত ঋণ পুনর্গঠনের অনুমোদনও দেয়া হয়েছে। দেশের ব্যাংকিং খাতের সার্বিক চিত্রটা ছিল এমনই। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক ১৪টি ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম ছড়িয়ে পড়ায় তা সামাল দিতেই বছর কেটে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তবে এ সময়ে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রম কিছুটা সামনে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ অবস্থায় নতুন বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে ঋণ বিতরণ ও সুশাসনই প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দেশের ব্যাংকিং খাতে চলতি বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ও আগামী বছরের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ২০১৫ সালে ভালো-মন্দ দুই-ই ছিল। এ সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে, যা দুঃখজনক। পাশাপাশি বড় ঋণগুলো পুনর্গঠন করা হয়েছে। বিষয়টি বিধিসম্মত হয়নি, এটা নৈতিকতাবিরোধীও। এ অবস্থায় ২০১৬ সালে আমানতকারীদের আস্থা ধরে রাখাটাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির স্বার্থে সুদের হার আরো কমিয়ে আনতে হবে।

গত অর্থবছর ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে অর্জন হয় ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিতরণ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। যদিও অক্টোবর পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণ ৫ লাখ ৫৩ হাজার ৭৫ কোটি টাকার ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। যদিও জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৫২ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৫০ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা।

ঋণ অনুমোদনেও ঘটেছে অনিয়ম। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাধ্য হয়েই পর্ষদে পর্যবেক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সর্বশেষ হিসাবে ১৪টি ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হচ্ছে— সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি, বিডিবিএল, বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল, মার্কেন্টাইল, ইসলামী ও আইসিবি ইসলামিক। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে পিপলস লিজিং ও বিআইএফসি। পর্যবেক্ষকরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ সভায় উপস্থিত থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখলেও পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটছে না সেভাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, পর্যবেক্ষক নিয়োজিত করায় ব্যাংকগুলোয় উন্নতি না হলেও পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে না।

হল-মার্ক, বিসমিল্লাহসহ নানা কেলেঙ্কারির ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে সোনালী ও জনতা ব্যাংক। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে বেসিক ব্যাংক। এছাড়া সরকারি প্রায় সব ব্যাংকই মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে সরকারি মালিকানার রয়েছে ছয়টি। সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের। ব্যাংকটির ঘাটতির পরিমাণ ৬ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। এছাড়া বেসিক ২ হাজার ৯৯১ কোটি, সোনালী ২ হাজার ১৫ কোটি, জনতা ৬৬৩ কোটি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ৫৩২ কোটি ও রূপালী ব্যাংক ৩৭৪ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। আর বেসরকারি খাতের ব্যাংকের মধ্যে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ৪১৯ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ২৮৫ কোটি ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১৫ কোটি টাকা। সরকারি ব্যাংকগুলোর মোট মূলধন ঘাটতি ১৪ হাজার ৫৫ কোটি টাকা পূরণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ফলে চলতি বছর মূলধন ঘাটতিতেই থাকবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নের ফলে আরো বেড়ে যাতে পারে ঘাটতি।

চলতি বছর ব্যাংকিং খাতের ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বেক্সিমকো গ্রুপের এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবের পরই এ সুযোগ দেয়া হয়। এতে ১১ প্রতিষ্ঠানের ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন হয়। সবচেয়ে বেশি পুনর্গঠনের সুবিধা নিয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ। রাষ্ট্রীয় মালিকানাভুক্ত চারটি ও বেসরকারি খাতের চারটি ব্যাংকের মোট ৫ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বেসরকারি খাতের তিনটি ব্যাংকে শিকদার গ্রুপের ১ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা পুনর্গঠিত হয়েছে।

এছাড়া ১০ ব্যাংকে যমুনা গ্রুপের ১ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকে এনন টেক্স গ্রুপের ১ হাজার ৯৪ কোটি টাকা, ছয় ব্যাংকে এসএ অয়েল রিফাইনারি ও সামানাজ গ্রুপের ৯২৮ কোটি টাকা, পাঁচ ব্যাংকে কেয়া গ্রুপের ৮৭৯ কোটি, তিন ব্যাংকে রতনপুর গ্রুপের ৮১২ কোটি, জনতা ব্যাংকে থার্মেক্স গ্রুপের ৬৬৭ কোটি, চার ব্যাংকে আবদুল মোনেম গ্রুপের ৫৭৭ কোটি এবং তিন ব্যাংকে বিআর স্পিনিংয়ের ৫৭২ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দেয়া হয়েছে। এছাড়া রাইজিং স্টিল মিলকেও ৫২২ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দেয়া হয়।

শুধু দেশীয় ঋণ নয়, বিদেশ থেকে আনা ঋণও অপব্যবহার করেছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৮০ প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ৪১৯ মিলিয়ন ডলার ঋণগ্রহণের অনুমোদন দেয়া হয়। ঋণের অর্থ অপব্যবহারে ব্যাংকিং খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, ইস্টার্ন ও ব্র্যাক ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। করপোরেট খাতের এপেক্স, প্রাণ-আরএফএল, অনন্ত, নাজ বাংলাদেশ লিমিটেড, ইপিলিয়ান লিমিটেডসহ আরো অনেকের নাম এসেছে অপব্যবহারের তালিকায়।

তবে বছরের শুরুতে ঋণের ওপর চড়া যে সুদহার ছিল, তা কমে এসেছে। মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা, বিদেশী ঋণ অনুমোদনের কারণেই কমে এসেছে সুদের হার। সর্বশেষ হিসাবে গড় সুদের হার নেমে এসেছে ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশে। আমানত ও ঋণের সুদ হারের স্প্রেড নেমে এসেছে ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশে, বছরের শুরুতে যা ছিল ৫ শতাংশের বেশি।

এদিকে রেমিট্যান্সপ্রবাহে ভাটা পড়েছে কিছুটা। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৬ হাজার ১৬৯ মিলিয়ন ডলার। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স ছিল ৬ হাজার ২১২ মিলিয়ন ডলার। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে একের পর এক রেকর্ড হয়েছে। ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৩৪৫ মিলিয়ন ডলার।

তবে এ সময়ে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রমে অগ্রগতি দেখিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১০ টাকায় হিসাব খোলা, কৃষক ও হতদরিদ্রদের পুনঃঅর্থায়ন, স্কুল ব্যাংকিং, পথশিশুদের ব্যাংক হিসাব সাড়া জাগিয়েছে। কৃষিঋণ, বর্গাচাষী ঋণ, এসএমই ঋণ, গ্রিন ব্যাংকিংয়ের সুফল দেশ পাচ্ছে বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি জনগণের দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছাতে মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম জোরদার হয়েছে। দেশের ৫৬টি ব্যাংক ও ৩২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে কাজ করছে। ব্যাংকের শাখা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ২১৪টি আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান ২১০টি।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) ভাইস চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, বছরের শুরুর তিন মাসে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতেই বাকি নয় মাস চলে গেছে। তবে এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক। কিন্তু যেসব খেলাপি ঋণ গোপন রাখা হয়েছে আর যেসব ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছে, তা আগামী বছর ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। সূত্র: বণিক বার্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.