ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে
সাকিব তনু | রাজনৈতিক অস্থিরতায় ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাস ব্যবসা-বাণিজ্যে ছিল মন্থরতা। তবে পরের নয় মাস স্বাভাবিক পরিস্থিতির সুবাদে ব্যবসা-বাণিজ্যে যে গতি এসেছে, তার প্রমাণ মিলছে দেশের ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফায়। পাশাপাশি ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ ও পুনর্গঠনে বিশেষ ছাড়সহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা নীতিসহায়তারও সুফল পেয়েছে ব্যাংক। সব মিলিয়ে গেল বছর ২০১৪ সালের তুলনায় ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
তবে পরিচালন মুনাফায় উল্লম্ফনের এ হিসাব প্রাথমিক। চূড়ান্ত হিসাব শেষে পরিচালন মুনাফা থেকে সঞ্চিতি ও কর কেটে রেখে ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা পাওয়া যাবে। খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর করপোরেট কর কমারও একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিট মুনাফায়।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোকে ৪০ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হবে, আর তালিকাবহির্ভূদের দিতে হবে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সিদ্ধান্ত অনুসারে নতুন ব্যাংকগুলোর করপোরেট করহার ৪০ শতাংশ।
ব্যাংকের মুনাফা প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাস খারাপ থাকলেও বাকি নয় মাস পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল। ফলে আগের বছরের তুলনায় ব্যবসা কিছুটা ভালো হয়েছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, এতে ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। সঞ্চিতি ও কর দেয়ার পরও মুনাফা আগের বছরের তুলনায় বাড়বে বলে মনে হচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা কমেছে। অন্যদিকে বেড়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মুনাফা। পরিচালন মুনাফার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে— ইসলামী, সাউথইস্ট, ইউসিবিএল, এবি ও সিটি ব্যাংক।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বরাবরের মতো এবারো মুনাফায় শীর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটি ২০১৫ সালে পরিচালন মুনাফা করেছে ১ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা; যা আগের বছর ছিল ১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। মুনাফায় শীর্ষস্থানীয়দের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সাউথইস্ট ব্যাংক। ব্যাংকটি গেল হিসাব বছরে ৮৩৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। আর পরিচালন মুনাফা আগের বছরের চেয়ে কমলেও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইউসিবিএল। এর পরের অবস্থানটি রয়েছে পূবালী ব্যাংকের দখলে। প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ বছরে ৮১০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। তালিকার পঞ্চম স্থানে থাকা ব্র্যাক ব্যাংক ২০১৫ সালে ৭৯০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে।
বিপরীতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক। বিগত বছরগুলোয় ঋণ বিতরণে বিভিন্ন অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির কারণে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান বেড়েছে। ২০১৪ সালে বেসিক ব্যাংকের পরিচালন লোকসান ছিল ১১০ কোটি টাকা; যা ২০১৫ সাল শেষে ২২৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর বাইরে মুনাফায় পিছিয়ে থাকা ব্যাংকের তালিকায় সরকারি কমার্স ব্যাংক ছাড়াও রয়েছে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলো। অন্যান্য সরকারি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফাও আশানুরূপ হয়নি।
সরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা বলছেন, নতুন পর্ষদ ঋণ বিতরণে অনেক সতর্ক ছিল। নতুন করে ঋণ বিতরণ সেভাবে না হওয়ায় মুনাফাও আশানুরূপ হয়নি।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ১৭ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল ৫০ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে বিতরণকৃত মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৫৩ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৫৪ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা; যা এ সময়ের বিতরণ কর করা ঋণের ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিতরণ করা ঋণ যথাযথ ব্যবহার না হওয়ায় তা খেলাপি হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি এসব ঋণ গ্রহণেও নানা অনিয়ম সংঘটিত হচ্ছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক রকম বাধ্য হয়েই এসব প্রতিষ্ঠানের পর্ষদে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে। সর্বশেষ হিসাবে ১২টি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এগুলো হলো— সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, বেসিক, কৃষি, বিডিবিএল, বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল, মার্কেন্টাইল, ইসলামী ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।
এদিকে গত বছর ব্যাংক খাতের ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণগ্রহীতাদের জন্য বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বেক্সিমকো গ্রুপের এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবের পরই এ সুযোগ দেয়া হয়। এতে ১১ প্রতিষ্ঠানের ১৫ হাজার ২১৮ কেটি টাকা ঋণ পুনর্গঠন হয়। সবচেয়ে বেশি ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা নিয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ।