মস্কোর শীতের তুষার কন্যা এখন বসন্তের রাজকন্যা

শাকিলা সিমকী
মস্কো থেকে বিবিসি বাংলার জন্য

শুভ্র তুলতুলে মেঘে সাঁতার কেটে আমাদের প্লেন যখন মস্কো শহরে ঢুকলো, ‘বার্ডস আই ভিউ’তে প্লেনে বসেই খেয়াল করলাম পুরো শহরটাই কেমন জরাজীর্ণ। খুব বোঝার চেষ্টা করেছিলাম এসব কী?

গাছপালা হলে তো সবুজ দেখবার কথা।

প্লেন যখন একটু একটু করে নামতে শুরু করলো বুঝতে পারলাম সব পাতাহীন গাছ আর কংক্রিটের রাস্তা আর বাড়ি ঘর। পুরো শহরটাই কেমন নিঃসঙ্গ আর সেখানে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিলো। তাই এর নাম দিয়েছিলাম ‘ছাইরঙা শহর’।

রাশিয়া আসবো শুনে বিবিসির এক ছোট ভাই নাগিব বলছিল, “রাশিয়া যাবেন ওখানে তো কাঁদতেও পারবেন না।”

ভেবেছিলাম ও হয়তো আমার আবেগের কথা ভেবেই বলেছে। তবু জিজ্ঞেস করলাম, ”কেন?”

সে হেসে উত্তর দিলো, “ওখানে এত ঠাণ্ডা যে চোখের পানিও জমে বরফ হয়ে যাবে।”

ওর কথা শুনে অনেক হেসেছিলাম সেদিন কিন্তু ঠাণ্ডার তীব্রতা আঁচ করতে পারিনি তখনো। মস্কোতে মাইনাস আট আর তীব্র হিমেল হাওয়া যখন আমাদের স্বাগতম জানালো তখন আমি নাগিবের কথার অর্থ হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।

রাশিয়াতে মূলত চারটি ঋতু। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ‘জিমই’ অর্থাৎ শীত; মার্চ থেকে মে ‘ভেসনা’ অর্থাৎ বসন্ত; জুন থেকে অগাস্ট ‘লেতম’ অর্থাৎ গ্রীষ্ম আর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর হচ্ছে ‘ অসিন’ শরত কাল।

মস্কোতে আমার আগমন নভেম্বরের মাঝামাঝি। শরত-এর শেষ দিকে শীতের আগমনী। ফলে, বারো মাসে ন’মাস শীতের প্রকোপে কাবু থাকা দেশে আমি মুল সময়টাতেই এসে পড়েছিলাম।

সুতরাং ঠাণ্ডার প্রকোপ কী আমি এই জীবনে নতুন করে জানলাম, দেখলাম।

সমস্ত শহরে সূর্যের কোন আলো নেই। চারপাশ বিষণ্ণ। ছাইরঙা সব। যখন তখন তুষার পড়ে। জীবনের প্রথম তুষারপাত উপভোগ করবো কি। আমার নিজেকে মনে হলো বন্দি পাখি আর মস্কো শহর মস্ত খাঁচা।

সকাল হতে হতে সন্ধ্যা নামে ঝুপ করে। দিন ছোট রাত বড়। বাইরে কোথাও কোন আড্ডা নেই। নেই চায়ের টং, নেই শীত কালে খালার হাতের গরম গরম ভাপা পিঠা। পথ ঘাট নিস্তব্ধ।

প্রতিদিন মাইনাস শীত আর তুষারের যতো পরিমাণ বাড়তে লাগলো আমার মন ততো বিষণ্ণতায় নিমজ্জিত হতে লাগলো । মানুষগুলাকে মনে হতো যন্ত্র। শীত বস্ত্র গায়ে জড়িয়ে ব্যস্ত মানুষগুলো কাজে বের হতো যন্ত্রের মতো।

এখানে যতই তুষার পাত হউক কারো কাজ থেমে নেই। আমার মতো অলস যারা তাদেরও সকাল সাড়ে আটটার ক্লাস ধরতে সাতটায় উঠতে হতো। কান্নার উপায় কই? আগেই বলেছি।

শুনেছি রাশিয়ায় এমন কিছু শহর আছে যেখানে দিনের বেলাতেও রাতের মতো অন্ধকার। ‘অয়মিকনা’ নামক এক শহর আছে যেখানে ঠাণ্ডার তীব্রতা এতো বেশি যে মাইনাস ৩০ তাদের স্বাভাবিক ঠাণ্ডা। জানুয়ারিতে মাইনাস ৫৫ আর ফেব্রুয়ারিতে নাকি -৬০ হয়।

তাহলে ভাবতে পারছেন ওখানকার অধিবাসীদের বাস করা কতটা যুদ্ধের! ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্য তাদের পশমের তৈরি পোশাক পরিধান করতে হয়।

পশমের স্কার্ফ তাদের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এবং স্কার্ফের মাধ্যমে তারা এমনভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নির্গত করে যেন কিছুটা উষ্ণ বাতাস তাদের ফুসফুসে ঢুকতে পারে।

অয়মিকনার বাসিন্দারা পথে ঘাটে ভদকা গ্রহণ করতে পারে না, কারণ ঠাণ্ডার তীব্রতায় স্রেফ দু’মিনিটের মধ্যে ভদকা বরফে পরিণত হয়। আর দিনের বেলাও হাফ মিটার দূরের জিনিস দেখা যায়না ল্যাম্পের আলোতেও।

পথে আপনি পাশ কেটে যাওয়া গাড়ি আসছে বুঝবেন শুধু শব্দের মাধ্যমে। আর স্থানীয় বাসিন্দারা টয়লেটের কাজটাও সারেন রীতিমতো গরম পোশাক পরে বাইরে গিয়ে, কারণ আধুনিক উপায়ে মাটি খনন করে পাইপ বসানোর উপায়টাও নেই তাদের বরফ জমে থাকার কারণে।

তাই অয়মিকনার বাসিন্দাদের কাছে মস্কোর মাইনাস বিশ-পঁচিশ তাপমাত্রা হাস্যকর। আবার মস্কোবাসীদের কাছে হয়তো আমাদের মতো উষ্ণ দেশগুলোর ঠাণ্ডা হাসির পাত্র।

আসলে জীবনে কোন কিছু মুখোমুখি না হলে বুঝবার উপায় নাই কতটা টিকে থাকা সম্ভব।

তবে মস্কোর বাইরের গ্রাম বা শহরের বাসিন্দাদের কাছে মস্কো এক আশার আলো। তুষার-ঘেরা হিম শীতল ঘন অন্ধকারে বেঁচে থাকা মানুষগুলো স্বপ্ন দেখে মস্কো আসবার।

চেখভ, পুশকিন, টলস্ত্য় আরও বিখ্যাত লেখক কবিদের লেখায় ফিরে এসেছে বারবার মস্কো আসার আকাঙ্ক্ষা। আর হবে নাই বা কেন।

ন’মাস শীতে কাবু থাকা মানুষগুলোর জন্য মস্কোতে এক উজ্জ্বল জীবন। এখানে নাইট ক্লাব, থিয়েটার, জিম, শপিং সেন্টার, সিনেপ্লেক্স সব রকম বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। তাই রাত যত বাড়ে তাদের ঝিমধরা শহর জেগে ওঠে।

বাইরে যতই শীত থাকুক না কেন, অন্দরে ততোটাই শীতকে বশ মানিয়েছে রুশবাসি। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা সেরে নিজেকে স্ট্রেস ফ্রি রাখতে ছুটে যাবে নাইট ক্লাবে, জিমে আর থিয়েটারে।

আর এখানে রাত হয় বা কখন সারাদিন তুষারপাতে রাস্তার রকমারি আলোর ঝলকানিতে রাতকেও দিন মনে হয়। বরফের সাদা রিফ্লেক্সের কারণে এখানে রাতের রঙ হয়ে ওঠে ‘জোছনা রঙ’ আর রুশ জাতি তাই এর নাম দিয়েছে ‘সাদা রাত্রি’।

সে যাই হউক আমার মতো গরম দেশের মানুষের পক্ষে মাইনাস শীত অনেক কিছু। গাছে কোন পাতা নেই শুনে আমার ভাগ্নি প্রশ্ন করেছিল, ”তুমি অক্সিজেন পাও কি করে?” আমি হেসেছিলাম ওর কথা শুনে।

আমার সরল ভাবনায় এসেছিলো, তাই তো গাছ থেকে আমরা অক্সিজেন পাই আর গাছ গ্রহণ করে কার্বন ডাই অক্সাইড। তাইতো! পাতা হীন গাছের শহরে আমি কী করে বেঁচে আছি!

তবে মানুষ যে অভ্যাসের দাস আমি নিজেই তার প্রমাণ। এত বিষণ্ণতার মাঝেও স্নো-ফল দেখে ভালো লাগে। তুষারপাতে রুশ বাচ্চাদের আনন্দ দেখে আমারও আনন্দ হয়।

তবে বরফের মাঝে হাঁটা চলা বেশ কঠিন। পিচ্ছিল পথে কতবার কতজনকে পড়তে দেখেছি। এরা অভ্যস্ত এই জীবনে। এদের হোঁচট খেতে খেতেই বড় হয়ে ওঠা। নরম শুভ্র বরফ গুঁড়িতে যেমন বিষণ্ণতা আছে তেমনি আছে এক ধরনের আনন্দ ও বিলাসিতা।

গত তিনমাসে বসন্তের জন্য আমার অপেক্ষার সময় মনে ভাবনা ছিল, গ্রীষ্ম আসার আগে কী করে এত কম সময়ে গাছগুলোতে পাতা ফুল আর ফল ধরবে। কী করে এতো জলদি বরফ গলে শুকনা পথ হবে! নানা ভাবনা এসেছে মনে।

মার্চ-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত তুষার ছিল। মার্চের শেষের দিকে অবাক করা পরিবর্তন হতে লাগলো।

বরফ গলে পানি হয়ে পথ ঘাট কদাকার হয়ে গেলো। বরফের আধিপত্য শেষ হবার সাথে সাথে দস্যি বাতাস হানা দিল। সেও আবার হাড় কাঁপানো হিম বাতাস। যদিও বসন্তের শুরুটা বাংলাদেশের কোকিল ডাকা আর কৃষ্ণচূড়ায় ছাওয়া ছিলনা।

তবে এপ্রিলের শুরু হতে না হতেই পথ ঘাট ঝকঝকে হয়ে গেলো কোথাও কোন কাদা বা পানি নেই।

এতদিনের বরফে ঢাকা মাটিগুলো প্রাণ ফিরে পেয়ে সবুজ ঘাসে ছেয়ে গেছে। আবার অবাক করে দিয়ে যেখানে সেখানে হলুদ ফুলও ফুটেছে। প্রতিদিন মস্কোর প্রাকৃতিক এই পরিবর্তন আমাকে অবাক করে দিচ্ছে।

সত্যি সত্যি বিশাল বিশাল পাতাহীন গাছগুলোতে কুড়ি এসেছে। পাখি ডাকছে। নানা গাছে নানা রকম ফুল আর পাতা গজাচ্ছে। বরফের সাদা বৈধব্য ছেড়ে মস্কো তার নতুন রূপের ঢালি খুলেছে। খোলসের আভরণ ছেড়ে আড়মোড়া দিয়ে জেগেছে শহর আর জেগেছে রুশবাসি।

যন্ত্রমানব থেকে তারা এক একজন প্রাণবন্ত মানুষে পরিণত হয়েছে। ফুরফুরে মেজাজে মস্কোর আলো বাতাসে তারা অবগাহন করছে। যেখানে সেখানে নানারকম বাদ্য-বাজনা নিয়ে গান গাইছে। পথিকেরা সেই আনন্দ মনে মাখছে।

কোথাও কোথাও মেলা বসেছে, ছোট ছেলে মেয়েরা সেই মেলায় নানারকম আনন্দে মেতে উঠেছে। রূপকথার নানা সাজে বাচ্চাদের আনন্দ দিচ্ছে।

আমি শুধু অবাক হয়ে মস্কোর এই পরিবর্তন দেখছি আর ভাবছি আমার মনের যত ভাবনা মস্কো এক তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে দেখিয়ে দিলো রূপকথার সেই তুষার-কন্যা ছিল আসলেই এক রাজকন্যা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.