মাতৃদুগ্ধবিষয়ক সচেতনতা
মাতৃদুগ্ধবিষয়ক সচেতনতা
প্রফেসর এম সাইফুর রহমান
জন সুস্থ শিশু জাতির একটি মূল্যবান সম্পদ। আর শিশুর স্বাস্থ্য সুস্থ রাখতে মায়ের দুধের বিকল্প নেই। শিশুর যথাযথ বৃদ্ধি ও বিকাশে মায়ের দুধের ভূমিকা অপরিসীম। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ শিশুকে দেয় পরিপূর্ণ পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা, যা নিশ্চিত করে শিশুর মজবুত ভিত্তি। শিশুর পাশাপাশি স্তন্যদান মায়েদের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট উপকারী, যা মাকে অতি দ্রুত গর্ভপূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে। তাই সব শিশুকে জন্মের প্রথম ঘণ্টা থেকে শুরু করে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে।
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আর এই শিশুদের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে দরকার সঠিক পুষ্টি ও পরিচর্যা। শিশু জন্মের প্রথম ১ ঘণ্টা থেকে প্রথম ৬ মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধই যথেষ্ট। এই সময়ে মায়ের দুধই নিশ্চিত করে শিশুর সঠিক পুষ্টি। এ ছাড়া মাতৃদুগ্ধে উপস্থিত কিছু উপকারী ব্যাকটেরিয়া শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। শিশু মাতৃগর্ভে আসার প্রথম দিন হতে শুরু করে শিশুর দুই বছর পর্যন্ত এই ১০০০ দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই ১০০০ দিনের মধ্যেই শিশুর পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটে। তাই এই ১০০০ দিনে মা ও শিশুর সঠিক পরিচর্যাই পারে একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ আগামী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর হিসাব অনুযায়ী জন্ম থেকে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত পৃথিবীর শিশুকে শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানো হলে বছরে ১৫ লাখেরও বেশি শিশুর অকালমৃত্যু রোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশ সরকার মা ও শিশুর সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করার প্রত্যয়ে গত ৭ বছরে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। বর্তমানে মাতৃত্বকালীন ছুটি বেতনসহ ৬ মাসে উন্নীত করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অফিসে মাতৃদুগ্ধ কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিল থেকে কর্মজীবী মায়েদের ভাতা দেয়া হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে মা ও শিশুস্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হয়েছে। দেশের সব হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে শিশুবান্ধব হিসেবে পরিণত করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের এসব পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে শিশুকে শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার ৪৬ থেকে ৬৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অতি সন্নিকটে পৌঁছে গেছে। শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসের জন্য বাংলাদেশ এমডিজি অ্যাওয়ার্ড এবং দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ডসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। তা ছাড়া দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়নে মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে খুব সহজেই একজন মা যেকোনো জটিল বিষয়ে জানতে বা পরামর্শ নিতে পারছেন।
সরকারের এই উদ্দেশ্য সফল করার লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি কিছু বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা মা ও শিশুর পুষ্টি উন্নয়নকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন নেসলে বাংলাদেশ বিভিন্ন হাসপাতালে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য মাতৃদুগ্ধ কর্নার স্থাপনে এগিয়ে এসেছে ও তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছে এবং মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রতি বছর স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক কর্মশালার আয়োজন করে আসছে। সরকারের পাশাপাশি সহযোগী হিসেবে কাজ করার জন্য এই বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে সাধুবাদ জানাই।
এ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার জন্য দরকার আরো অধিক সচেতনতা। আর এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে একসাথে কাজ করে যেতে হবে। আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ, সরকারি-বেসরকারি সবার সম্মিলিত প্রয়াসে আসুন আমরা এই শিশুদের নিয়ে একটি চমৎকার ভবিষ্যৎ নির্মাণে একসাথে কাজ করি এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০১৫ ও ভিশন ২০২১-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে একটি সুস্থ, সুন্দর বাংলাদেশ গড়ি।
লেখক : হেড অব ডিপার্টমেন্ট, পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ