মাত্রাতিরিক্ত কার-রিকশায় ঢাকার অচলায়তন
ইসমাইল আলী |
রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেট কার) নামছে প্রতিদিন গড়ে ৫০টির বেশি। আর রিকশা নামছে ১০০টিরও বেশি। ব্যক্তিগত গাড়ি ও রিকশার আধিক্যে সংকুচিত হয়ে পড়ছে গণপরিবহন তথা বাস চলাচলের পথ। এতে ক্রমেই অচলায়তনে ঢুকে পড়ছে ঢাকা শহর।
ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার (আরএসটিপি) জন্য গত বছর এ সমীক্ষা চালায় সংস্থাটি। জাইকার ওই সমীক্ষায় বিষয়টি উঠে এসেছে। গত মাসে প্রকাশিত আরএসটিপির খসড়া প্রতিবেদনেও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
সমীক্ষার তথ্য বলছে, রাজধানী ও এর আশপাশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৬৭ লাখ মানুষ বাস করে। এদের দৈনিক যাতায়াতের (ট্রিপ) সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৯৩ লাখ। এ ট্রিপের মাত্র ৫ শতাংশ হয় ব্যক্তিগত গাড়িতে। অথচ শহরের প্রধান সড়কগুলোর ৭২ শতাংশ দখল করে রাখে এসব গাড়ি। বাস-মিনিবাসে ২৪ শতাংশ ট্রিপ হলেও শহরের প্রধান সড়কগুলোর মাত্র ১২ শতাংশ দখলে থাকে এসব পরিবহনের।
এছাড়া শহরের অপ্রধান সড়ক ও বাইলেনগুলোর প্রায় ৯৫ শতাংশই থাকে রিকশার দখলে। অথচ রিকশায় ট্রিপ হয় শহরের ২৩ শতাংশ। এক্ষেত্রে আরেকটা সমস্যা হচ্ছে রিকশায় খুবই কম দূরত্বে যাওয়া যায়। বাহনটিতে ট্রিপের গড় দূরত্ব ৩ দশমিক ৬ কিলোমিটার; যেখানে বাসে গড়ে ৯ দশমিক ৭ কিলোমিটার পর্যন্ত যাতায়াত করে শহরবাসী।
সমীক্ষা বলছে, ঢাকা শহরে সড়কের পরিমাণ খুবই সীমিত। একটি আদর্শ শহরে সড়ক থাকতে হয় মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ। এর বিপরীতে ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। এর মধ্যে মোটরযান চলতে পারে, এমন প্রধান সড়ক ৩ শতাংশ। সীমিত এ সড়কের বড় অংশই ব্যক্তিগত গাড়ি ও রিকশার দখলে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, শহরে গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সব দেশেই একটি কর্তৃপক্ষ থাকে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এ ধরনের কোনো দায়িত্বই পালন করছে না। অথচ প্রতি বছর হাজার হাজার ব্যক্তিগত গাড়ি নিবন্ধন দিচ্ছে সংস্থাটি। শহরের কী অবস্থা হবে, তা বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। এর চেয়েও খারাপ অবস্থা রিকশার ক্ষেত্রে। বাহনটি নিয়ন্ত্রণে কোনো কর্তৃপক্ষও নেই। যত খুশি রিকশা নামছে ঢাকায়। এসব ছোট পরিবহন শহরে যানজট বাড়াচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গণপরিবহন ব্যবস্থা। ফলে ক্রমেই অচল হয়ে পড়ছে ঢাকা।
সমীক্ষা অনুযায়ী, গত ১০ বছর ঢাকায় নতুন ব্যক্তিগত গাড়ি নেমেছে ১ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি। এছাড়া ২০১৩ সালে ফিটনেস সনদ নিয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজারের বেশি পুরনো গাড়ি। অর্থাৎ ঢাকায় এখন ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের ওপর। অথচ এসব গাড়িতে গড়ে দেড়জন যাতায়াত করে। এ হিসাবে সাড়ে তিন লাখ ব্যক্তিগত গাড়িতে যাতায়াতকারীর সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজারের কিছু বেশি।
প্রতিদিন ঢাকায় কত সংখ্যক রিকশা নামছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে গত ১০ বছরে এ শহরে দৈনিক গড়ে ১০০টির বেশি অবৈধ রিকশা নেমেছে। বর্তমানে ঢাকায় অবৈধ রিকশা রয়েছে প্রায় ১০ লাখ। আর বৈধ রিকশা মাত্র ৯০ হাজার। এসব রিকশায় গড়ে ১ দশমিক ৬ জন যাতায়াত করে। অর্থাৎ ১১ লাখ রিকশায় যাত্রী সংখ্যা মাত্র ১৭ লাখ ৬০ হাজার।
তথ্যমতে, গণপরিবহন ব্যবস্থার সংকটে ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। গত কয়েক বছরে ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। মধ্যম আয়ের মানুষও এখন ব্যক্তিগত গাড়ির দিকে ঝুঁকছে। আর উচ্চ আয়ের মানুষের মধ্যে গাড়ি ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। তবে উচ্চ আয়ের লোকজনও রিকশা ব্যবহার করে উচ্চমাত্রায়।
মাসিক আয় ৬০ হাজার টাকা, এমন জনগোষ্ঠীর ট্রিপ সংখ্যা ঢাকায় ২৫ লাখ ১১ হাজার। এর মধ্যে ৬ লাখ ৩৯ হাজার বা সাড়ে ২৪ শতাংশ ট্রিপ হয় ব্যক্তিগত গাড়ির মাধ্যমে। আর রিকশায় ট্রিপ হয় ৬ লাখ ৬৬ হাজার বা সাড়ে ২৬ শতাংশ।
জাইকা বলছে, ঢাকায় ১ কোটি ১৭ লাখ ৩৩ হাজার ট্রিপ হয় হেঁটে। অর্থাৎ ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ যাতায়াত করে হেঁটে। অথচ পথচারীদের জন্য পর্যাপ্ত ফুটপাত নেই রাজধানীতে। যেসব স্থানে ফুটপাত রয়েছে, তাও বেদখল। কোথাও বসেছে হোটেল-রেস্তোরাঁ, কোথাও রিকশা গ্যারেজ, কোথাও আবার ফুটপাতের ওপরই পার্কিং করা হচ্ছে গাড়ি।
এদিকে রাজধানীতে বাসে ট্রিপ হয় দৈনিক ৬৯ লাখ ৫১ হাজার বা ২৪ শতাংশ। এর বিপরীতে ঢাকায় বাস রয়েছে ছয় হাজারের কিছু বেশি। এসব বাসে গড়ে ৫২ জন করে যাতায়াত করে। অথচ বাস ব্যবস্থা উন্নয়নেও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বিশ্বব্যাংক বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজির (এক রুটে এক কোম্পানির বাস পরিচালনা) কথা বললেও তা করা হয়নি।
বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সারওয়ার জাহান বলেন, ঢাকার যানজট কমাতে হাঁটার পথ প্রশস্ত করতে হবে, যাতে জনগণ হেঁটে সুবিধাজনক গন্তব্যে পৌঁছতে পারে। রুট ফ্র্যাঞ্চাইজির পাশাপাশি বাসের জন্য পৃথক লেন প্রতিষ্ঠা করাও দরকার। এছাড়া নির্ধারণ করে দিতে হবে ব্যক্তিগত গাড়ি ও রিকশার সর্বোচ্চ সংখ্যা। এর চেয়ে বেশি ব্যক্তিগত গাড়ি বা রিকশা কোনোভাবেই ঢাকায় নামতে দেয়া যাবে না। তাহলেই ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার চিত্র পরিবর্তন করা সম্ভব হবে।