মিষ্টির যত কথা!

টুসি বোস

  

মিসরের ফারাও তুতেনখামেনের সমাধিতে নাকি মধু ও খেজুর-জাতীয় মিষ্টির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। সে হিসাবে মিষ্টি-জাতীয় দ্রব্য আবিষ্কার দুই সহস্রাব্দ আগে। ভারতবর্ষে এর আগমনের সময়টিও ধোঁয়াশাপূর্ণ। একইভাবে বাঙালির জীবনযাপনে মিষ্টির আবির্ভাব কবে, তা কেউ সঠিক বলতে পারেন না। এখন তা জড়িয়ে গেছে এ জাতির সংস্কৃতি ও জীবনে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে দুধে তৈরি মিষ্টির প্রচলন ঘটে। এটা মূলত বিকল্প উপায়ে দুধ সংরক্ষণের তাগিদে, যা এখনকার গোয়ালাদের দুধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের কাছ থেকে কেনা উদ্বৃত্ত দুধ সংরক্ষণের পন্থা হিসেবে তা থেকে মিষ্টি ও দই তৈরি শুরু করে ময়রা ও হালুই সম্প্রদায়ের মানুষ।

ছানার সন্দেশ

ছানা ও পনির তৈরির কাজ বাঙালিদের শিখিয়েছে পর্তুগিজরা। তবে ওই সময় বাড়িতে ছানা দিয়ে খাবার তৈরি হতোই না। এর পেছনে রয়েছে ধর্মীয় অনুভূতি। দুধ থেকে তৈরি নানা পদ সেবা করতেন দেবকূল। ননি-মাখন শ্রীকৃষ্ণের ভীষণ প্রিয়। ছানা উত্পাদন হয় দুধ প্রক্রিয়াজাত করে। বিষয়টিকে ভালোভাবে নেননি তত্কালীন ধর্মের কাণ্ডারিরা। তবে ছানা বাঙালিরাই বেশি ব্যবহার করে। ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যবিশারদ সুকুমার সেনের ‘কলকাতা কাহিনী’ বই থেকে জানা যায়, সংস্কৃত ভাষায় ‘ছানা’ বলে কোনো শব্দ ছিল না। তাই সে সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকায় দেবতাদের নিবেদনও করা হতো না তা। দুধে অন্য উপকরণ যুক্ত করে বাঙালি জলীয় অংশ ও সারবস্তু আলাদা করে ফেলছে। তৈরির উপায় লক্ষ করেই নামকরণ হয় ‘ছেনা’ বা ‘ছানা’। এটি বাঙালি মহলে সমাদৃত হওয়ার আগেই সন্দেশের আবির্ভাব ঘটে। সন্দেশ তৈরি হতো বেসন, নারকেল, মুগ ডালের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে। ছানা তৈরির কাজ শেখার পরই এতে চিনি ব্যবহার করে তৈরি বাঙালির মস্তিষ্কপ্রসূত ‘ছানার সন্দেশ’। পরবর্তীতে শীতের সময় চিনির বদলে গুড় মিশিয়ে তৈরি হতে লাগল গুড়ের সন্দেশ। বাংলার বাইরে ছানার সন্দেশের তেমন দেখা মেলে না।

রসগোল্লা

ওডিশা না পশ্চিমবঙ্গ? রসগোল্লার দুই যোগ্য হকদার। এ নিয়ে ভারতের দুই রাজ্যের মধ্যে বেশ গণ্ডগোলও হয়ে গেছে। ওডিশা রসগোল্লার আবিষ্কার ভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পেতে আবেদন জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। তবে কলকাতাও নাছোড়বান্দা। কিছুতেই দাবি ছাড়বে না রসগোল্লার ওপর। বিখ্যাত মিষ্টি প্রস্তুতকারক নবীন চন্দ্র দাসের পরিবারও কেন্দ্রের দ্বারস্থ হয়েছে। ১৮৬৮ সালে বাগবাজারে (তত্কালীন সুতানুটি) ছিল নবীন ময়রার মিষ্টির দোকান। তিনিই নাকি প্রথম ছানার মণ্ড চিনির সিরায় ডুবিয়ে তৈরি করেন রসগোল্লা। এ মিষ্টি আবিষ্কারের কাহিনী রয়েছে ওডিশায়ও। লক্ষ্মী দেবীর অভিমান ভাঙানোর জন্য জগন্নাথ দেব তাকে খাইয়েছিলেন ক্ষীরমোহন। সেই ক্ষীরমোহনই পরিচিতি পায় রসগোল্লা হিসেবে। আবার নথি ঘেঁটে পাওয়া গেছে অনেক তথ্য। তা হচ্ছে, রসগোল্লা আবিষ্কারে জড়িত অন্য কেউ। দাস শুধু তা জনপ্রিয় করে তুলতে সাহায্য করেছেন। খাদ্যবিশারদ প্রণব রায়ের এ-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল ১৯৮৭ সালে ‘বাংলার খবর’ পত্রিকায়। জানা যায়, ১৮৬৬ সালে কলকাতা হাইকোর্টের কাছেই ছিল ব্রজ ময়রার মিষ্টির দোকান। নবীন ময়রা রসগোল্লা বিক্রি শুরুর দুই বছর আগে সেখানে নাকি রসগোল্লা পাওয়া যেত। শুধু কি তাই! পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার হারাধন ময়রা উনিশ শতকে রসগোল্লা প্রথম তৈরি করেন বলে বিশ শতকের গোড়ার দিকে জানিয়েছেন পঞ্চানা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি রানাঘাটের পাল চৌধুরীদের জন্য কাজ করতেন। রসগোল্লার সর্বশেষ সংস্করণ স্পঞ্জের রসগোল্লা। তবে যে যা-ই বলুক, লা জবাব রসগোল্লা। রসে টইটম্বুর দেখেই হয়তো এ নামকরণ। আর খেতে তো অমৃত!

চমচম

ব্রিটিশ শাসনামল। ওই সময় আসাম ছেড়ে অবিভক্ত বাংলায় পাড়ি জমালেন দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি। বসত গড়েন টাঙ্গাইলের যমুনাতীরের পোড়াবাড়িতে। তবে দশরথ গৌড় সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। যমুনার সুস্বাদু জলে গরুর দুধ মিশিয়ে তৈরি করলেন বিশেষ ধরনের মিষ্টি। লম্বাটে আকারেই তৈরি করলেন এটি। নাম দিলেন চমচম। প্রতিবেশীরা খেয়ে ব্যাপক প্রশংসা করলেন এর। তার পর তো ইতিহাস। মাওয়ায় জড়ানো চমচমের গা গাঢ় বাদামি, কখনো খানিকটা লালচে। খেতেও সুস্বাদু। আর মাতাল করা ছানার গন্ধের জুড়ি নেই। একটু শক্ত হলেও ভেতরটা ঘন রসে ভরপুর, ফাঁপা। আগে চমচমের কোনো অস্তিত্ব ছিল না খাদ্য রসিকদের তালিকায়। তাই এর আদি ভূমি বাংলাদেশ, এ দাবি করাই যায়।

অমৃতি

ভূ-ভারতে অমৃতির উত্পত্তি বলে জানা যায়। বর্তমান ভারত ও বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয় একটি শুকনো মিষ্টি। লাল বা কমলা বর্ণের অমৃতি খানিকটা শক্ত হলেও ভেতরে রস থাকে। দুধ বা ছানা ব্যবহার হয় না। ডাল ভিজিয়ে বেটে নিয়ে তৈরি হয় অমৃতি।

রসমালাই

শোনা যায় পশ্চিমবঙ্গে রসমালাইয়ের প্রথম প্রচলন হয়। বাঙালি ময়রা কৃষ্ণ চন্দ্র দাস এর আবিষ্কারক। ঘন করে জ্বাল দেয়া দুধের সিরায় ডোবানো ছোটো মিষ্টির টুকরা ভিজিয়ে তৈরি হয় রসমালাই। বাংলাদেশের কুমিল্লা এর জন্য বিশেষভাবে বিখ্যাত। এ জেলায় তৈরি রসমালাইয়ের জনপ্রিয়তা রয়েছে ভিন দেশেও।

মণ্ডা

ময়মনসিংহ শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে মুক্তাগাছা। প্রায় ২০০ বছর আগের কথা। গোপাল পাল নামে এক ব্যক্তি স্বপ্নে দেখা পান এক সন্ন্যাসীর। তার কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন এক রকম মিষ্টি তৈরির প্রণালি। নাম ‘মণ্ডা’। তিনি মিষ্টি তৈরিকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করলেন। উত্তরসূরিরাও ধরলেন পূর্বপুরুষের ব্যবসার হাল। চ্যাপ্টা আকৃতির মণ্ডা ছানা ও চিনির রসায়নে প্রস্তুতকৃত এক ধরনের সন্দেশ। আজো মুক্তাগাছায় গেলে স্বাদ পাওয়া যেতে পারে এর। এ মণ্ডার প্রস্তুত প্রণালি কখনই পরিবারের বাইরে যায়নি। এমনকি যেখানে এটি তৈরি হয়, তার চৌকাঠ বাড়ির নারীদের পার হওয়াও বারণ। পূর্বপুরুষদের আদেশ মেনেই নাকি এ রীতি!

কালোজাম

মিষ্টির কথা বলতে গেলে মোগল আমলের কথা এসেই যায়। সে যুগে কালোজামের উত্পত্তি বলে শোনা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে তো এর সমাদর রয়েছেই, জনপ্রিয়তায় পৌঁছে গেছে তুর্কিতেও। চিনি, ছানা, মাওয়ার রসায়নে তৈরি মিষ্টি স্বাদেও ভিন্ন।

জিলাপি

পশ্চিম এশিয়া থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে জিলাপির আগমন বলে জানা যায়। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অভিধান হবসন-জবসন অনুযায়ী, ‘জালেবি’ শব্দের বুত্পত্তি আরবি শব্দ ‘জুলাবিয়া’ অথবা পার্সিয়ান ‘জালিবিয়া’ থেকে। ইহুদিরা নাকি এ খাবারের সঙ্গে আগেই পরিচিত ছিল। রমজানের সময় ইরানে ধনী পরিবারগুলো জুলাবিয়া দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করত। ভারতীয় উপমহাদেশে এ মিষ্টি প্রথম নিয়ে আসে মুসলমানরা। ১৩ শতকে মুহম্মদ বিন হাসান আল-বোগদাদী লিখিত রান্নার বইয়ে এর বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে যেখান থেকেই আসুক না কেন, রসে ভেজা গরম গরম জিলাপি দেখলেই জিভে জল! আর স্বাদ নিয়ে কিছু না বললেও চলে!

বালিশ মিষ্টি

প্রায় ১০০ বছর আগের কথা। নেত্রকোনা শহরের বারহাট্টা সড়কে ছিল ‘গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। দোকানটির নাম স্বত্বাধিকারী গয়ানাথ ঘোষের নামেই। তার স্বপ্ন ছিল নতুন কোনো ধরনের মিষ্টি আবিষ্কার। সে আশায় একদিন বিশাল আকারের মিষ্টি তৈরি করলেন। তা জনপ্রিয় হয়ে উঠতেও খুব বেশি সময় লাগল না। দেখতে অনেকটা বালিশের মতো। ক্রেতাদের পরামর্শে নাম রাখলেন ‘বালিশ মিষ্টি’। সে সময় কেবল তার দোকানেই পাওয়া যেত এটি। পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়ে সবখানে; নেত্রকোনা ছাড়িয়ে সারা দেশে। গয়ানাথের মিষ্টি বলেও পরিচিতি রয়েছে এর।

 

মিথে ‘মিষ্টি’

ভারতীয় উপমহাদেশে মিষ্টি নিয়ে রয়েছে অনেক মিথ। গিরি গোবর্ধনে শ্রীকৃষ্ণ ধ্যানে বসেছিলেন। ধ্যান ভঙ্গের পর সঙ্গীদের নতুন কিছু রান্নার আদেশ দিলেন। ভক্তরা গিরিধারীর মনোরঞ্জনে তৈরি করলেন রকমারি সুস্বাদু মিষ্টি। আবার নারায়ণ দেবের ‘পদ্মপুরাণ’ থেকে জানা যায়, বেহুলা-লখিন্দরের বিবাহ উপলক্ষে ১২ রকমের আমিষ ও ১১ নিরামিষ পদ রান্না করা হয়। শেষ পাতে ছিল ছয় ধরনের মিষ্টি।

 

বাঙালির মিষ্টির ইতিহাস বহু পুরনো। এর আধিপত্য আজ বাংলা ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশ-দেশান্তরে। বিবর্তনের ধারায় সবকিছুরই পরিবর্তন হয়। সে ধারায় ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির সঙ্গে যোগ হচ্ছে নিত্যনতুন পদ। এর সবই যে দুধ-ছানায় তৈরি, তা নয়। ময়দা, বেসন, ডালযোগে তৈরি মিষ্টির চাহিদা বাড়ছে। এক দশক আগেও দোকানিরা ক্রেতাদের হাতে ধরিয়ে দিতেন সস্তা দরের প্যাকেটভর্তি মিষ্টি। কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্যাকেটেও এসেছে পরিবর্তন। পরিসর বড় হচ্ছে ব্যবসার। শেষ পাতে একটু মিষ্টিমুখ না করালে বাঙালির নিত্যভোজ পরিপূর্ণতা পায় না। আর উত্সব-পার্বণে তো কোনো কথাই নেই। মিষ্টি চাই-ই চাই। তাই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বলি ‘জয়তু! মিষ্টি’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.