মুগ্ধতায় শেষ হলো ঢাকা আর্ট সামিট
রুবেল পারভেজ |
সময় আর সুযোগের অভাবে যারা এ শহর ঘুরে ঘুরে শিল্প দর্শন করতে পারেননি, তাদের জন্য জুতসই মুহূর্ত ছিল গত চারদিন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে ফেব্রুয়ারির ৫ থেকে ৮ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ঢাকা আর্ট সামিটে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় দেখে অন্তত এমনটিই বলা চলে।
বিশাল এ আয়োজনের সমাপনী দিন ছিল গতকাল। ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মানুষে মুখর হয়ে উঠেছিল উত্সবস্থল। চিত্রশালার প্রধান ফটক পেরোতেই চোখ চলে যায় ক্যানভাসে ঠাঁই পাওয়া শিল্পী মুনেম ওয়াসিফের বেশ কয়েকটি চিত্রকর্মের দিকে। সাদা-কালো রঙে ছাওয়া পাহাড়-টিলা-সরু রাস্তাসদৃশ এ ছবিগুলোর আপাত কোনো মানে খুঁজে পাওয়া সম্ভব না হলেও খানিকটা সময়ের ব্যবধানে দর্শনার্থীর কাছে আপনা-আপনিই উত্তরগুলো এসে ধরা দেয়। জানান দেয়, ভূমিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মানুষের জীবনপ্রণালির কথা। মুখোমুখি দাঁড় করায় সেই সত্যের কাছে, যা বর্তমান রাষ্ট্র কিংবা সমাজের অবনত রূপটিকেই তুলে ধরে নিঃসংকোচে।
ঢাকা আর্ট সামিটের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, দেশের প্রধান প্রধান আর্ট গ্যালারির সম্মিলন ঘটানো। বেঙ্গল, দৃক, সানতারান আর্ট অর্গানাইজেশন, সানফ্লায়ার, চিত্রকসহ বেশ কয়েকটি গ্যালারি তাদের বাছাইকৃত শিল্পকর্মগুলো দিয়ে চিত্রশালার ৬ নম্বর গ্যালারি সাজিয়েছিল। একই প্লাটফর্মে এত গ্যালারির বিচিত্র সব আয়োজন একসঙ্গে দেখতে অন্যান্যদের সঙ্গে হাজির হয়েছিলেন সেলফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারটেলের চিফ সার্ভিস অফিসার রুবাবা দৌলাও। তার ভাষায়, ‘বিশাল পরিসরের এ ধরনের আয়োজন করে বাংলাদেশ সবাইকে এই বার্তা দিতে পারে— আমরা যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত। ঢাকা আর্ট সামিটের মধ্য দিয়ে এ দেশের শিল্প ভাবনা আরো বহির্মুখী হওয়ার সুযোগ পাবে।’
এদিন সকাল থেকেই শিশু শিক্ষার্থীদের আগমনে মুখর ছিল শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। শিক্ষক, অভিভাবক ছাড়াই তারা সারিবদ্ধভাবে পুরো আয়োজন ঘুরে ঘুরে উপভোগ করছিল। এদের মধ্যে কাউকে কাউকে আবার ডায়াসে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশে রূপকথার গল্প আওড়াতে দেখা গেল। কথা হয় এদেরই একজনের সঙ্গে। নাম জুবায়ের হোসাইন রিহ্যাব। এখানে এসে তোমার কেমন লাগছে? ‘এই অনুষ্ঠানে আসার জন্য আজ আমাদের স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস দেখতে পেরে মজা লাগছে।’ মূলত ভবিষ্যত্ প্রজন্মের মাঝে শিল্পবোধ তৈরি ও আগ্রহ বাড়াতেই এমন আয়োজনের ঘোষণা ছিল আগে থেকেই। সব মিলিয়ে এবারের উত্সবে মোট ৫০টি স্কুল অংশগ্রহণ করেছে।
এদিকে স্থাপত্যবিদ্যাকে যারা শুধুই একাডেমিক পরিসরে ভাবতে ইচ্ছুক, তাদের সেই ভুল ভাঙাতে এবারের সামিটের বিশেষ আয়োজন ছিল, বাংলাদেশী স্থপতিদের করা বিভিন্ন নকশা উপস্থাপন। মডার্ন অ্যান্ড কনটেম্পরারি আর্কিটেকচার, থ্রি মডেলস, ব্লু প্রিন্টসহ নানা বিষয়ের উপস্থাপনায় পূর্ণ ছিল এ বিভাগের আয়োজন। এ প্রদর্শনী নিয়ে আরেকটি কথা না বললেই নয়, স্থাপত্য বিষয় হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই আগত দর্শনার্থীদের বয়স হওয়ার কথা ছিল একটু বেশি। কিন্তু সেই ভুলও ভেঙে দিয়ে শিশুরাই প্রধান দর্শনার্থী হয়ে হাজির হয়েছিল গতকাল। প্রতিটি নকশার দিকে অমোঘ দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকা দেখে বোঝা গেল, স্থাপত্যবিদ্যায় আগামীর বাংলাদেশ অনেক বেশি সফল হবে।
বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমন্ত্রিত শিল্পী, শিল্পকর্ম আর আয়োজনের বিচিত্রতা ১২ হাজার স্কয়ার ফুট আয়তনের জাতীয় চিত্রশালা ভবনটিকে সত্যিই গোটা পৃথিবীর রূপ দিয়েছিল। যে পৃথিবীতে হাজার হাজার সংস্কৃতি, জাতিসত্তা আর শৈল্পিক নানা বিষয়ের সমাগম হয়েছিল। যেখানে সুন্দর একটি পৃথিবী তার অবারিত মুগ্ধতা ছড়িয়ে আগত সবাইকে খানিকটা সময়ের জন্য হলেও শিল্পসৌন্দর্যে বুঁদ করে রেখেছিল। হয়তো এ কারণেই আগত সবার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘আরো বড় হয়ে ফিরে এসো ঢাকা আর্ট সামিট।’