মেঘ ছেড়েছে ঘর – রমজান আলী মামুন

এই নিয়ে প্রায়ই টিনু মামার সাথে তর্ক হয় তার। মামা বলেন অন্য কথা।
: বুঝলি নোটন, চিড়িয়াখানা হলো বাংলাদেশের সপ্তম আশ্চর্যের একটি। অথচ তুই সেটাই দেখলি না। পাঠ্য বইÑএ চিতাবাঘের ছবি দেখেই একেবারে ভয়ে কুঁকড়ে গেলি। কত করে বললাম চল।
না আমার ভয় করে মামা। ওরা যদি লোহার আগল ভেঙে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাড়টা মটকে দেয়, তখন? নোটনের কথা শুনে টিনু মামা হাসেন।
: তুই যে এমন ভীতু। তোকে আমার ভাগনে ভাবতেই কষ্ট হয়। ঢাকা শহরটা মামার কাছে একেবারে স্বর্গের মতো। টিনু মামা বলেন তা না হলে সুখের শ্যামপুর ছেড়ে এখানে এসে থাকি? : ইস মামা, তুমি এত্তো বানিয়ে বলো। লেখাপড়া শিকেয় তুলে টো টো করে ঘুরে বেড়াও বলেইতো নানু তোমাকে শ্যামপুর থেকে ঢাকা শহরে নির্বাসন দিয়েছেন।
: ভুল শুনেছিস ভাগনে ভুল। আমি তো ইচ্ছে করেই তোদের বাড়িতে এসেছি। এবং ইচ্ছে করলেই চলে যাব। হঠাৎ শিলু আপা ফোড়ন কেটে ওঠে। : বাব্বা। আম্মুকে তুমি যা ভয় পাও। তাইতো শ্যামপুরে যেমন তেমন করে চললেও এখানে এসে দিব্যি লক্ষ্মী ছেলের মতো লেখাপড়া করছ। তাইনা গুল মামা?
: কি বললি আমার সাথে ইয়ার্কি হচ্ছে বুঝি? তোকে আমি ছাতু পিঠা করে ছাড়ব। টিনু মামা শিলু আপাকে আর পায় কোথায়? সে মামাকে ক্ষেপিয়ে তুলেই ভৌ দৌড়। ক’দিন ধরে বৃষ্টি পড়ছে একটানা অবিরাম বৃষ্টি, সেই যে মেঘে মেঘে সূর্য একবার ডুব দিয়েছে তার আর দেখা নেই। বাদলা দিনের স্বভাবটাই এরকম। এই একটু ফর্সা হয়ে আসে তো আবার গুড়–ম গুড়–ম শব্দ করে সমস্ত আকাশ আবছা আলো আঁধারির মধ্যে ছেয়ে যায়। বৃষ্টির দিনে ঘরকুনো হয়ে বসে থাকতে ভাল্লাগেনা নোটনের। অথচ ঘরের নিষেধ ডিঙ্গিয়ে বাইরে যাবার সুযোগও সব দিক থেকে বন্ধ। এক জোড়া চোখ নোটনকে সব সময় তীক্ষ্ম প্রহরায় রাখে। কিছুক্ষণ আগেও এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আর এখন কৃষ্ণচূড়া জলপাই গাছের ফাঁকে ফাঁকে দুধ সাদা ঝলমলে রোদের মাখামাখি। ড্রয়িং রুমে বসে টিনু মামা মিলুর সাথে হল্লা করে লুডু খেলছে। খেলার মধ্যেই ছোট্ট মিলু আপন মনে ছড়া কাটে; “মেঘের কোলে রোদ হেসেছে/বাদল গেছে টুটি/আজ আমাদের ছুটি ও ভাই/আজ আমাদের ছুটি।”
সত্যি কি তাই? মেঘের কোলে রোদ হাসলেই কি আম্মু তাকে বাইরে যাবার অনুমতি দেবেন? কখনো না। বরং বলবেন বাদলা দিনে বাইরে গিয়ে কোনো কাজ নেই। তারচে’ ভালো তোমার টিনু মামাকে নিয়ে কেরাম খেলো গিয়ে। আম্মুর শাসনকে ভীষণ ভয় পায় নোটন। বৃষ্টির পানিতে ভিজে খেলতে গিয়েছে শুনলে সারা বাড়িটা মাথায় তুলে ছাড়বে।
: ‘এই যে নোটন।’ মামার ডাকে সচকিত হয় সে।
: তুই এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস? আর আমি তোকে খুঁজেই পাগল। চল্ চল্ টিভি দেখবি আয়।
: না মামা আমি দেখব না। তুমি যাও।
: আরে না করিস ক্যান? আজ ঝন্টু-পন্টুর শেষ পর্ব। দেখতে যা মজা হবে না। গত সিরিজে পটল মামাকে ভূতেরা যেভাবে খাব খাব বলে তেড়ে আসছিল তা দেখে বুঝলি ভাগনে আমার তো বুকের ছাতি শুকিয়েই কাঠ। নোটন বিজ্ঞের মতো ঘাড় ফিরিয়ে বলে, কি বললে? মামা তুমি কি আসলে ভূতটুত বিশ্বাস করো?
: নির্ঘাৎ করি। তোর মতো আমিও আগে বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এখন করি। তোরা তো শহরে থাকিস। ভূতের ফাঁদেতো কোনোদিন পড়িসনি, তাই এসবের কি বুঝবি? গ্রামে থাকলেই বুঝতে বাছাধন ভূত কাকে বলে।
: থামো মামা থামো। গুল মারতে হবে না। আমরা গ্রামের বাড়িতে থাকি না বুঝি? সামনেই তো আবার যাচ্ছি।
: গেলেও তোরা থাকিস ক’দিন। আর ক’দিন থেকেই এসবের কি বুঝবি?
: হয়েছে মামা ঢের হয়েছে। ভূতের কীর্তি-কলাপ আমাকে আর শুনাতে হবে না। টিভি সেটের সামনে চোখ বুঁজে এবার বসো গিয়ে।
: তুইও আস না নোটন। আজকের পর্বটা জমবে ভালো।
: আরে ধ্যাৎ মামা। তুমি যে কি। সামনে আমার পরীক্ষা আর তুমি কিনা আমাকে ভুতুড়ে সিরিজ দেখাতে উতলা হচ্ছো। নোটন পাটিগণিত নিয়ে বসেছে। কয়েকটা অংক কষতে না কষতেই হঠাৎ বকুলের কথা মনে পড়ে যায় তার। বড় কাকুর ছেলে বকুল। ওরা গ্রামের বাড়িতেই থাকে। নোটনেরাও আগে গ্রামের বাড়িতে থাকত। পরে আব্বুর চাকরির সুবাদে ওরা ঢাকায় চলে আসে। বকুল লিখেছে হাবলু, বীরু কি একটা ডিটেকটিভ ক্লাব করেছে। এবার স্টাডিটুরে ওদের ডিটেকটিভ ক্লাবের সদস্যরা নাকি কি সব এ্যাডভেঞ্চার করে বেড়াবে। সে আরও লিখেছে ‘তোমারও তো পরীক্ষা শেষ হতে যাচ্ছে। তাইনা নোটন? ডিটেকটিভ হতে চাইলে শীঘ্রই চলে এসো।’ বকুলের চিঠি পেয়ে উত্তেজনায় নোটনের সর্বাঙ্গ রিনিঝিনি করে ওঠে। পড়ায় সে আর মন বসাতে পারে না। শিমুলতলিতে দিনগুলো বেশ কাটে ওর। হারিয়ে যাওয়া দিনের অনেক কিছুই খুঁজে পায় সে। বাবলা বনের ভেতর রাখালের বাঁশির সুর। বেতসলতার ঝোপে পাখিদের কিঁচির-মিচির ডাক আর জ্যোৎøা আলোয় রূপালি নদীতে মাছের সে কি দাপাদাপি। বুড়ো বটগাছটার নীচে বসে বৈশাখী মেলা। দুপুর মাথায় করে বকুলের সাথে নোটন চলে যেত সে মেলায়। মাটির খেলনা পুতুল, তিলের নাড়–র চেয়ে তাকে বেশি টানতো কাঠের ঘোড়া। নাগরদোলায় চড়ে বসলে তো বাড়ি যাওয়ার কথাই ভুলে যেত নোটন। মায়াভরা সে গ্রাম আজও তাকে খুব টানে। পড়ার ঘরে জানালা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস ঢুকে পড়ে। বাতাসের ঝাপটায় তার কোঁকড়ানো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। কার্ণিশ ছুঁয়ে বেড়ে ওঠা নারিকেল গাছের ফাঁক দিয়ে রূপোর থালার একফালি চাঁদ দেখা যায়। শন শন শব্দ করে নারিকেল পাতাগুলো বাতাসের সাথে একটানা নাচতে তাকে। আর তখন দোতলার ছোট রুমটিতে অসাড় হয়ে পড়ে থাকতে ভীষণ কষ্ট হয় নোটনের। পা টিপে টিপে সিঁড়ি ভেঙে ছাদের উপর এসে দাঁড়ায় সে। পাশের বাড়ির ছোট্ট সুমন বড় করে করে কবিতা পড়ছে। ‘বহুদিন পরে মনে পড়ে আজি/পল্লী মায়ের কোল/ঝাউশাখে যেথা বনলতা বাঁধি/হরষে খেয়েছি দোল।’ বড় করে না পড়লে সুমনের নাকি পড়াই মুখস্থ হয় না। তার আবৃত্তির ভঙ্গি চমৎকার। মিলু আপা কবিতার এক নাম্বার ভক্ত। সুমনকে কাছে পেলে চকলেট দিয়ে আচ্ছা করে আবৃত্তি শোনে। কিছুক্ষণ আগেও দূর আকাশে ধবধবে এক রূপোলি চাঁদ মিটিমিটি হাসছিল। এখন বিশাল আকাশ জুড়ে খণ্ড খণ্ড কালো মেঘের আনাগোনা। আবছা অন্ধকারে খোলা আকাশের দিকে অপলক চোখে চেয়ে থাকে নোটন। তার মন তখন ফেলে আসা গ্রামের স্মৃতিতে ডুবে গেছে আবার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.