মোবাইল ফোন বিপ্লব, ল্যান্ড ফোনের খবর কী?

বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি৷ এরমধ্যে মোবাইল ফোন গ্রাহক ১২ কোটিরও বেশি৷ এ পর্যায়ে এসে মোবাইল ফোন গ্রাহক বাড়ায় প্রবৃ্দ্ধিতে ধীর গতি লক্ষ্য করা গেলেও, তা ল্যান্ড ফোনের চেয়ে অনেক বেশি৷
বাংলাদেশে মোবাইল ফোন এখন শুধু প্রত্যন্ত এলকায়ই পৌঁছায়নি, এর ব্যবহারকারী এখন সব শ্রেণির মানুষ৷ উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত – সবার হাতেই মোবাইল ফোন৷ শুরুতে এটা এক ধরনের ফ্যাশন ছিল, কিন্তু এখন মোবাইল ফোন ফ্যাশন নয়, প্রয়োজন৷ টেলি কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ এবং অ্যাসোসিয়েশন অফ মোবাইল ফোন অপারেটর্স ইন বাংলাদেশের সাবেক মহাসচিব আবু সাঈদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা শহুরে মানুষরা গ্রামের সাধারণ মানুষকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেখে হয়তো নাক সিঁটকাতে পারি৷ কারণ, আমাদের ভাবনাটাই ঐ রকম৷ কিন্তু গ্রামের কৃষক এর প্রয়োজনীয়তা বুঝে গেছে৷ সে এখন জানে, যোগাযোগের এই বহনযোগ্য ডিভাইস তার কী উপকারে আসে৷”
বাংলাদেশে প্রথম মোবাইল ফোন চালু হয় ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে৷ হাচিসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (এইচবিটিএল) ঢাকা শহরে এএমপিএস মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল ফোন সেবা শুরু করে৷ ১৯৯৬ সালে এটিই সিডিএমএ প্রযুক্তি দিয়ে সিটিসেল নামে কাজ শুরু করে৷ তখন মোবাইল ফোনের সংযোগ এবং কলরেট ছিল আকাশছোঁয়া৷ সিটিসেল গত বছর বন্ধ হয়ে গেছে৷ এখন যে পাঁচটি মোবাইল ফোন অপারেটর সক্রিয় আছে, তারা জিএসএম প্রযুক্তি ব্যবহার করে৷ সেগুলো হলো: গ্রামীণ ফোন, রবি, এয়ারটেল, বাংলা লিংক এবং টেলিটক৷ টেলিটক রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান৷ বাকিগুলো বেসরকারি এবং বিদেশি বিনিয়োগে গড়ে উঠেছে৷ এরমধ্যে গ্রামীণ ফোনের মার্কেট শেয়ার সবচেয়ে বেশি৷ ১২ কোটি গ্রাহকের ৯ কোটিই গ্রামীণ ফোনের বলে তাদের দাবি৷ বর্তমানে রবি ও এয়ারটেল একীভূত হয়ে রবি হবার কাজ করছে৷
২০১৩ সাল থেকে তৃতীয় প্রজন্মের থ্রি-জি সেবা দেয়া শুরু করে মোবাইল ফোন অপারেটররা৷ এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই শুরু করেছে ফোর-জি সেবা দেয়া৷ আর এখানেই আছে মোবাইল ফোনের গোলক ধাঁধাঁ৷ প্রশ্ন যদি করা হয়, বাংলাদেশের থ্রি-জি সেবা কি পুরোমাত্রায় চালু হয়েছে? তার জবাব হবে, না৷ তাহলে কেন ফোর-জি? আবু সাঈদ খানের কথায়, ‘‘এটা তো আমারও প্রশ্ন৷ আসলে সেবা না বাড়িয়ে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো চমক দিতে চাচ্ছে৷ এটাই সমস্যা৷ যেখানে থ্রি-জি সেবাই পুরোমাত্রায় চালু করতে পারেনি অপারেটররা, সেখানো ফোর-জি আসে কীভাবে?”
তিনি বলেন, ‘‘গ্রাহকরা মোবাইল ফোনে আনইন্টেরাপ্টেড কথা বলতে চান৷ কিন্তু এখানে সেটা সম্ভব হচ্ছে না৷ দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে বারবার কল ড্রপ হয়৷ ফলে মোবাইল ফোন ব্যবহারের খরচ বেড়ে যায়৷ কলরেট বিবেচনায় বাংলাদেশে সাধারণভাবে মনে হবে, মোবাইল ফোনের খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি নয়৷ কিন্তু সেবার মান বিবেচনা করলে সেটা অবশ্যই বেশি৷”
বাংলাদেশে মোবাইল ফোন আসার আগে টিঅ্যান্ডটির ল্যান্ড টেলিফোনের ওপরই নির্ভর করতে হতো টেলিফোন সেবার জন্য৷ সেই টেলিফোন ছিল যেন সোনার হরিণ৷ সাধারণ মানুষ একটি টেলিফোন সংযোগের জন্য আবেদন করে বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও সংযোগ পেতেন না৷ ভাগ্যবান যারা সেটা পেতেন, তাদেরও গুনতে হতো সরকারি মাশুল ছাড়াও মোটা অঙ্কের টাকা৷
এই উপমহাদেশে ১৮৫৩ সালে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ল্যান্ড ফোনের যাত্রা শুরু হয়৷ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বিভাগ৷ ১৯৭৬ সালে এ বিভাগটিকে একটি কর্পোরেট সংস্থায় রূপান্তরের পর, ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বিভাগকে পুনর্গঠন করে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বোর্ড (বিটিটিবি)৷ এরপর তারা দেশব্যাপী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদান শুরু হরে৷ ২০০১ সালে টেলিযোগাযোগ আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) নামে আলাদা একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে টেলিযোগাযোগ খাতের নীতি নির্ধারণ ও তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়৷ এরপর ২০০৮ সালে বিটিটিবিকে লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত করে এর নতুন নাম দেয়া হয় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)৷ বেসরকারি খাতেও ল্যান্ড ফোনের সেবা বিস্তৃত করা হয়৷ পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক (পিএসটিএন) নামের এক ধরনের ফোন কোম্পানির সংখ্যা বিটিসিএলসহ মোট আটটি৷ বিটিসিএল-এর শতভাগ শেয়ার রাষ্ট্রের৷
এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ব বিটিসিএল-এর গ্রাহক সংখ্যা সারাদেশে মাত্র সাড়ে ছয় লাখ৷ অন্যদের গ্রাহক তেমন নেই৷ সব মিলিয়ে দেড় লাখের মতো হবে৷ এছাড়া বিটিসিএল-এর ল্যান্ড ফোনের জন্য নাগরিকদের সেই অতীতের আগ্রহ আর নাই৷ এখন চাইলেই ল্যান্ড ফোনের কানেকশন পাওয়া যায়৷ বিলও অনেক কম৷ অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল, ন্যাশনওয়াইড ডায়ালিং, সারাদেশে একই কলরেট, তারপরও সাধারণ মানুষ এর প্রতি আর আগের মতো আগ্রহী নয়৷
বিটিসিএল-এর বিভাগীয় প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন মাসুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন সারা বিশ্বেই ল্যান্ড ফোনের প্রতি গ্রাহকদের আগ্রহ কমছে৷ মোবাইল ফোনের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে৷ কারণ, এটি সহজে বহনযোগ্য৷ তারপরও আমরা নানাভাবে ল্যান্ড ফোনের প্রতি আগ্রহ ধরে রাখার চেষ্টা করছি৷ এখন আমাদেরও ল্যান্ড ফোন টু ল্যান্ড ফোন কলরেট প্রতি মিনিট ৩০ পয়সা৷ রাতের বেলা আরো কম, ১০ পয়সা৷ বিদেশের কলরেটও আগের চেয়ে কম৷ এর সঙ্গে আমরা এখন টেলিফোনের পাশাপাশি ডাটা সার্ভিসও দেই৷”
ল্যান্ড ফোনের প্রতি মানুষের দীর্ঘদিনের অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘এখন আর অভিযোগ নেই৷ এখন ঢাকায় ২১শ’ টাকায় ল্যান্ড ফোন সংযোগ নেয়া যায়৷ উপজেলা পর্যায়ে মাত্র ৫০০ টাকা লাগে৷ তাছাড়া আমাদের সার্ভিসও এখন নিরবিচ্ছিন্ন৷”
২০১০ সালের মে মাসের হিসেবে বিটিসিএল-এর গ্রাহক ছিল ৮ লাখ ৭২ হাজার৷ এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ছয় লাখে৷ মোবাইল ফোনের প্রতি মানুষের যে আগ্রহ, তাতে এই গ্রাহক সংখ্যা আরো কমবে বলে মনে করা হচ্ছে৷ বাংলাদেশের শহর এলাকায় একসময় কয়েনবক্সের মাধ্যমে এবং পরে কার্ডফোন চালু করা হয়েছিল৷ গ্রামাঞ্চলে টেলিকম সুবিধা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ল্যান্ড লাইনে বেতারভিত্তিক পাবলিক কল অফিস স্থাপন করা হয়েছিল৷ কিন্তু এসবই হারিয়ে গেছে মোবাইল ফোন বিপ্লবের কাছে৷
বাংলাদেশের মানুষ এখন ফোনকে শুধুমাত্র কথা বলার মাধ্যম হিসেবে দেখে না৷ এখন তারা এটাকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে দেখছে৷ এর ডাটা বা ইন্টারনেট সার্ভিস প্রত্যন্ত গ্রামেও সমানভাবে পাওয়া যায়৷ আর এটা সম্ভব করেছে মোবাইল ফোন৷ এটা মানুষের অর্থনীতি, শিক্ষা, বিনোদনসহ জীবনের প্রায় সবদিকে ভূমিকা রাখছে৷
আবু সাঈদ খান বলেন, ‘‘ফোন এখন এলিটদের চিন্তার দেয়াল ভেঙে সাধারণ মানুষের হয়েছে৷ তাই এটাকে সত্যিকার অর্থে সবার ফোন করতে আরো বেশি গ্রাহকবান্ধব হতে হবে৷”
সূত্র: ডয়চে ভেলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.