যমুনায় হাঁটুপানি
সেতু তৈরি ও নদী শাসন করে পশ্চিম পারে বাঁধ, গ্রয়েন, হার্ডপয়েন্ট নির্মাণের ফলে চরম নাব্য সংকটে পড়েছে যমুনা। ১৯৯৮ সালের পর থেকে যমুনা সেতুর উজানে নদী ভরাট হয়ে চর জাগতে শুরু করে। এখন যমুনা সেতুর উজানে সিরাজগঞ্জ থেকে কুড়িগ্রাম পর্যন্ত ২৩০ কিলোমিটার নদীতে ছোট-বড় চরের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। নতুন আরো এক হাজার চর জেগে ওঠার অপেক্ষায় আছে। এক সময়ের প্রমত্তা যমুনা এখন নাব্য হারিয়ে বিভিন্ন রুটে নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। যমুনার বুকে এখন ধু-ধু বালু চর। মাইলের পর মাইল হেঁটে চরে বসবাসরত মানুষ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করছে।
যমুনা সেতুর পশ্চিম পাশ থেকে শুরু করে উত্তর প্রান্ত কুড়িগ্রাম পর্যন্ত নদীর অববাহিকায় দেড় হাজারের বেশি চর জেগেছে। এ সবের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন শতাধিক চরে মানুষ বসবাস করে। শিক্ষার আলো, স্বাস্থ্য, সড়ক সেবাসহ প্রায় সব ধরনের নাগরিক সেবা বঞ্চিত এ সব মানুষ। বালির মাঝেই চাষাবাদ এবং গরু-ছাগল পালন এদের প্রধান পেশা। এখন অবশ্যই অনেকে চরে মরিচ, আলু, বাদাম, গম, ভুট্টাসহ প্রায় সব রকমের ফসলের চাষ করে। তারপরও এই চারের কৃষকরা বঞ্চিত কৃষি সেবা থেকে। কিছু না পেলেও এদের না পাওয়ার কোনো অভিযোগ নেই। সাঘাটার দিঘলকান্দি চরের বাসিন্দা মির্জা নূরন্নবী বলেন, ‘আমরা চরের মানুষ অনেক সুখে আছি, ভালো আছি। আমরা কারো কাছে কিছু চাই না।’
এসব চর এলাকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চর হচ্ছে গাইবান্ধার ফুলছড়ি, টেংরাকান্দি, গাবগাছি, পারুল, খাটিয়ামারি, গলনা, খোলবাড়ি, সাঘাটা উপজেলার দিগলকান্দি, পাতিলবাড়ি, গুয়াবাড়ি, গাড়ামারা, হরিচন্দ্র, এজে-াবাড়ি, বগুড়ার ধুনট, বৈশাখী, ভা-াবাড়ি, মাঝিরার চর, সারিয়াকান্দি উপজেলার ধারাবর্ষা, শংকরপুর, চন্দনবাইশা, চর লক্ষ্মীকোলা, ডাকাতমারির চর, ইন্দুরমারির চর, চর কর্নিবাড়ি, তালতলা, বেনুপুর, পাকুরিয়া, চর মানিকদাইর, চর দলিকা, শিমুলতাইড়, চর কালুয়াবাড়ি, চর বিরামের পাঁচগাছি, নয়াপাড়া, জামথল, চর বাকিয়া, ময়ূরের চর, চর দেলুয়াবাড়ি, কুড়িপাড়ার চর, চর শালিকা, করমজাপাড়া, টেকামাগুরার চর। এসব চর ছাড়াও যমুনা পারে আরো অসংখ্য চর আছে। এসব চরের মানুষ আধুনিক বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে এখনো অবস্থান করছে। অনেক এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। বিদ্যুৎ তাদের কল্পনার বিষয়। সমসাময়িক প্রেক্ষাপট, দুনিয়ার অনেক তথ্য থেকে তারা এখনো অনেক ব্যবধানে আছে ।
এসব বালুচরের কারণে বর্ষা মৌসুমেও নৌকা চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। এছাড়াও উজান থেকে নেমে আসা সামান্য ঢলের পানিতেই নদী পরিপূর্ণ হয়ে অকাল বন্যা দেখা দেয়। বন্যার পরপরই নদীতে নতুন চর জেগে উঠায় নৌকা আর চলে না। ফলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য সহজে বাজারজাত করা যায় না। আবার বিভিন্ন জরুরি প্রয়োজনে হাট-বাজার, অফিস আদালত, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজে সময় মতো আসা তাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়েছে। চরাঞ্চলের মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা। নদী নাব্য হারিয়ে যাওয়ায় চরে তাদের বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। নদীতে না চলছে নৌকা আবার ধু-ধু বালুতে না চলছে কোনো যানবাহন। মাইলের পর মাইল তপ্ত বালুতে না যাচ্ছে হেঁটে পথ চলা।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, যমুনার মূল উৎপত্তি পাশের দেশ ভারতে। উৎপত্তি স্থল থেকে যখন পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করে তখন এর গতি থাকে অনেক। পানির গতির কারণে ভরতের অংশের মাটি বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন টন আমাদের নদীতে পড়ে। এর ফলে ক্রমান্বয়ে নদী ভরাট হতে থাকে। নদীর গভীরতা কমে বর্ষা মৌসুমে অল্প পানিতেই বন্যার সৃষ্টি হয়। তিনি আরো বলেন, ইতিমধ্যেই যমুনা ড্রেজিংয়ের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার একটি পাইলট প্রকল্প শুরু হয়েছে। এই প্রকল্প সফল হলে নদীর নাব্য ফেরাতে আরো বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে।