যাদেরকে দেখে আশা জাগে মনে

এই মুহূর্তে যখন এই প্রতিবেদনটি লেখা হচ্ছে, অথবা যখন এটি পাঠকরা পড়বেন, ঠিক সেই সময়টিতেই বিশ্বের আনাচে-কানাচে ৮০ কোটি আদম সন্তান ভুখাপেট নিয়ে আহাজারি করছেন। কেউবা শুধু এক মুঠো খাবারের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার দেয়া তথ্য এটি। সিরিয়ার মানুষ, ইরাকের মানুষ, লিবিয়ান তরুণ, ফিলিস্তিনী শিশু, আফ্রিকান নারী- ক্ষুধার্ত সবাই। গায়ে ছেঁড়া জামা। রোগবালাইয়ে কাবু হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী। কোনো সুশ্রুষা নেই তাদের। শুধু এ কয়টি দেশ বা এলাকা নয়, বিশ্বের সর্বত্রই আছে দারিদ্র্য-ক্ষুধা-অনাহার-বঞ্চনা-আহাজারি। এই মানুষগুলো তাদেরই স্বগোত্রের ক্ষমতালোভী আর সম্পদলোভী কিছু মানুষ দ্বারা সৃষ্ট দুর্ঘটনা-দুর্যোগ-যুদ্ধবিগ্রহের শিকার হয়ে আজ মানবেতর জীবন যাপন করছে। এসব দেখে বিবেকবান মানুষের দীর্ঘশ্বাস নেয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। হতাশা প্রকাশ ছাড়া আর কোনো ভাষা নেই এইসব দুর্ভাগা কোটি আদম সন্তানের কষ্ট লাঘবের। তবে এই হতাশার মধ্যেও কিছু মানুষ আশার আলো নিয়ে হাজির হন। নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাশে থাকা দুখী মানুষগুলোর কল্যাণ সাধনে। শুধু আমাদের চারপাশে নয়, সারা দুনিয়ায় ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সংখ্যায় অল্প হলেও এমন মানুষেরা ছিলেন সর্বকালে। বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার দোর্দ- প্রতাপ, শক্তির মদমত্ততা, নিষ্ঠুরতার চরম পরাকাষ্ঠার মুখোমুখি মানব জাতি, দুঃখী মানুষের দারিদ্র্য-ক্ষুধা-অনাহার-বঞ্চনার মাঝে দীর্ঘশ্বাস নেয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। কিন্তু দঃখী মানুষের কল্যাণ সাধনে যুগে যুগে কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটে থাকে। মানবতার কল্যাণে অকাতরে ঢেলে দেয় তাদের সহায় সম্বল। বর্তমান সময়ের এমনি কয়েকজন বিশ্বখ্যাত পরোপকারী মানুষের সাথে পরিচয় করিয়েছে দিয়েছে ব্রিটেনে দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা। সেখান থেকেই বর্তমান বিশ্বের ২০ জন সেরা দানশীল ব্যক্তির তালিকা তুলে ধরা হল– বিল গেটস : বিল গেটস সবচেয়ে বেশি পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তি হিসেবে। তবে মাইক্রোসফটের মালিক এই মার্কিন প্রযুক্তিবিদ বর্তমানে তার বেশিরভাগ সময় ব্যয় করছেন সমাজকল্যাণে। তার প্রতিষ্ঠিত বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি পরিচালনা করছেন গেটস। এখন পর্যন্ত তার দানের পরিমাণ ২৭ বিলিয়ন ডলার, যা তার মোট সম্পদের ৩২ শতাংশ। ওয়ারেন বাফেট : বার্কশায়ার হ্যাথওয়ের চেয়ারম্যান এবং সিইও ওয়ারেন বাফেটের মোট সম্পদ ৬১ বিলিয়ন ডলার। যার ৩৫ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলারই তিনি সমাজকল্যাণে ব্যয় করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাফেট ২০০৬ সালে ঘোষণা দেন যে, তার জীবদ্দশায়ই নিজের সম্পদের ৮৬ শতাংশ বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দান করবেন। জর্জ সরোস : সরোস ফান্ড ম্যানেজম্যান্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠাতা তিনি। হাঙ্গেরিতে জন্ম নেয়া এই মার্কিন নাগরিকের সম্পদের পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলার, যার ৩৩ শতাংশ বা ৮ বিলিয়ন ডলার মানুষের কল্যাণে ব্যয় করছেন সরোস। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং জরুরি ত্রাণসহ বিভিন্নভাবে ব্যয় হয়ে থাকে তার এসব দান। আজিম প্রেমজি : ভারতীয় এই বিলিয়নেয়ার বিশ্বের অন্যতম দানশীল ব্যক্তিদের একজন। নিজের মোট সম্পদের অর্ধেকই তিনি মানবকল্যাণে ব্যয় করছেন। আজিম প্রেমজির মোট সম্পদের পরিমাণ ১৭ বিলিয়ন ডলার। অলাভজনক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু দাতব্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা প্রেমজির নিজের নামে একটি ফাউন্ডেশনও রয়েছে। চার্লস ফ্রান্সিস ফিনী : দাতব্য কর্মকা-ে তার নেশার চাক ফিনী নামে সমধিক পরিচিত এই ব্যবসায়ীকে ‘জেমস বন্ড অব ফিলান্ত্রপি’ (দানশীলতার জেমস বন্ড) বলে ডাকা হয়। নিজের মোট সম্পদের পরিমাণ মাত্র দেড় বিলিয়ন ডলার। কিন্তু দান করেছেন ৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি! মূলত তার ভবিষ্যত সম্ভাব্য সম্পদকে কত হবে হিসাব করে তাও মানবকল্যাণে লিখে দিয়েছেন। ফিনী আয়ারল্যান্ডে জন্ম নিলেও বর্তমানে আমেরিকান নাগরিক। সুলাইমান বিন আবদুল আজিজ আল রাজী : নিজের বর্তমান সম্পদের চেয়েও দশগুণ বেশি দান করে এক অর্থে বিশ্বের সবচেয়ে উদার এবং দানশীল ব্যক্তি হলেন সৌদি আরবের নাগরিক সুলাইমান বিন আবদুল আজিজ আল রাজী। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৭ বিলিয়ন ডলার। তার ভবিষ্যত সম্পদও ইতোমধ্যে দানের খাতায় লিখে দিয়েছেন সুলাইমান। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংক আল-রাজী ব্যাংকসহ অসংখ্য বাণিজ্যিক এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সুলাইমানের বয়স বর্তমানে ৯৫ বছর। বাংলাদেশেও তার প্রতিষ্ঠিত বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গর্ডন মুর : বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইনটেল’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা মুরের মোট সম্পদ সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার। গর্ডন এন্ড বেটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ৫ বিলিয়ন ডলার, বা মোট সম্পদের ৭৭ শতাংশ দান করে দিয়েছেন এই মার্কিন ব্যবসায়ী। কার্লোস স্লিম : মেক্সিকান এই টেলিকমিউনিকেশন ব্যবসায়ী হলেন বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের। নিজের ২৭ বিলিয়ন ডলারের সম্পদের ৪ শতাংশ দান করেছেন মানবকল্যাণে। বিশেষ করে বিশ্বের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে তার ১০০ মিলিয়ন ডলারের অলাভজনক বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য। এলি ব্রোড : প্রযুক্তি ব্যবসায়ী এলি ব্রোড নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত ব্রোড ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নিজের সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের সম্পদের ৪৫ শতাংশই দান করে দিয়েছেন। মূলত বিজ্ঞান ও শিল্পকলা বিষয়ক গবেষণায় সম্পদ ব্যয় করছেন এই আমেরিকান। জর্জ কাইজার : আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিওকে ফাইনান্স করপোরেশনের চেয়ারম্যান কাইজারও একজন মার্কিন নাগরিক। শিক্ষা ক্ষেত্রে তার দানশীলতার উদাহরণ অতুলনীয়। প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদের ৩৫ শতাংশ ব্যয় করেছেন বিভিন্ন দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য। মাইকেল ব্লুমবার্গ : রাজনীতি করার পাশাপাশি আমেরিকার একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী মাইকেল ব্লুমবার্গ। মিডিয়ায় রয়েছে তার বড় ধরনের বিনিয়োগ। মোট ৩৭ বিলিয়ন ডলারের সম্পদের ৮ শতাংশ দান করেছেন মানবতার কল্যাণে। পল অ্যালেন : তিনি মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ১৭ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার দান করেছেন নিজের পরিবারের নামে প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে। মার্ক জুকারবার্গ : বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ২০ দানশীল ব্যক্তির তালিকায় আপাতত ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতার নাম ১৩ নম্বরে থাকলেও শিগগিরই তা একদম প্রথম দিকে উঠে আসার কথা। এতদিন তার মোট ৪৫ বিলিয়ন ডলারের সম্পদের ৪ শতাংশ মানবতার কল্যাণে ব্যয় করেছেন। তবে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রথমবারের মতো বাবা হওয়ার পর সদ্যজাত কন্যাসন্তানের জন্য ‘বসবাসযোগ্য পৃথিবী’ নির্মাণের আশায় নিজের পুরো সম্পদের ৯৯ শতাংশ দান করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জুকাবার্গ দম্পতি। লি কা শিং : হংকংয়ের নাগরিক এই ব্যবসায়ী এশিয়ার অন্যমত সেরা ধনকুবের। ২৬ বিলিয়ন ডলারের মালিক শিং নিজের সম্পদের ৫ শতাংশ ইতোমধ্যে সমাজকল্যাণে ব্যয় করেছেন। জন হান্টসম্যান জুনিয়র : আমেরিকান ব্যবসায়ী হান্টসম্যানের মোট সম্পদ ৯৪০ মিলিয়ন ডলার। ক্যামিক্যাল পণ্য প্রস্তুতকারক হান্টসম্যান করপোরেশনের মালিক দান করেছে বর্তমান সব সম্পদসহ ভবিষ্যতে অর্জন করবেন এমন সম্পদও। টেড টার্নার : টার্নার ব্রোডকাস্টিং সিস্টেমের মালিক দান করেছেন নিজের মোট ২ বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তির ৫৭ শতাংশ। জেমস সিমন্স : আমেরিকান গণিতবিদ সিমন্সের সম্পদের পরিমাণ ১২ বিলিয়ন ডলার। দান করেছেন দেড় বিলিয়ন ডলারের মতো। পিয়েরে অমিদিয়ার : ফ্রান্সে জন্ম নেয়া ইরানি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক পিয়েরে অমিদিয়ার অনলাইন ভিত্তিক বেচাকেনার প্রতিষ্ঠান ই-বে’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা। নিজের ৬ বিলিয়ন ডলারের সম্পদের ১৬ শতাংশ, বা এক বিলিয়ন দান করেছেন সমাজকল্যাণে। ডিটমার হপ : জার্মান প্রযুক্তি উদ্যোক্তা হপ দান করেছেন নিজের ৬ বিলিয়ন থেকে এক বিলিয়ন ডলার। দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.