যানজটে শারীরিক-মানসিক সমস্যায় ভোগে ৭৩% মানুষ
ইসমাইল আলী : যানজটে আটকে থেকে প্রতিদিন গড়ে দেড় ঘণ্টা সময় অপচয় হচ্ছে রাজধানীবাসীর। এতে আর্থিক ক্ষতি তো হচ্ছেই, পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক সমস্যায়ও ভুগছেন অনেকে। এর মধ্যে যাত্রী যেমন রয়েছেন, তেমনি আছেন গাড়িচালকও। আবার নিয়মিত যানজটে আটকে থাকার কারণে দীর্ঘস্থায়ী রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন কেউ কেউ। ফলে ঢাকাবাসীর স্বাস্থ্য সমস্যার অন্যতম কারণ হয়ে উঠছে যানজট।
যানজটের কারণ ও প্রভাব নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) ও নর্দান ইউনিভার্সিটি একটি যৌথ সমীক্ষা পরিচালনা করে। সমীক্ষার ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশ করা হয় কানাডিয়ান সেন্টার অব সায়েন্স অ্যান্ড এডুকেশনের জার্নাল অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটিতে। তাতে উঠে এসেছে যানজটে স্বাস্থ্যঝুঁকির এ তথ্য।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাড়ির ধোঁয়ায় থাকা বস্তুকণা ও সালফার-ডাইঅক্সাইড ফুসফুস, কিডনি জটিলতা ও হূদরোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। হূদযন্ত্রের প্রদাহ, নিউমোনিয়া ও ব্রঙ্কাইটিসের মতো সমস্যা সৃষ্টি করছে বাতাসে থাকা মাত্রাতিরিক্ত নাইট্রোজেন-ডাইঅক্সাইড ও সিসা।
সমীক্ষার তথ্যমতে, ঢাকা শহরে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষের বসবাস। এর প্রায় ৭৬ শতাংশই নানা প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে। এতে ঢাকাবাসীর সময় ব্যয় হয় দৈনিক গড়ে ২ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট। এর মধ্যে যানজটে আটকে থেকে নষ্ট হয় প্রায় দেড় ঘণ্টা।
যানজটে আটকে থেকে ৭৩ শতাংশ মানুষই নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে সাত ধরনের সমস্যায় বেশি ভুগছেন তারা। এগুলো হলো— শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা, মাথাব্যথা, মানসিক চাপ, শ্রবণশক্তি হ্রাস, অতিরিক্ত ঘাম, ক্লান্তি ও চোখের সমস্যা। এর বাইরে শ্বাসনালির সমস্যা, হূদযন্ত্রের সমস্যা, জ্বর, অ্যালার্জি, বদহজম ও বমির সমস্যাও রয়েছে।
যানজটে আটকে থাকা যাত্রীদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় শ্বাসপ্রশ্বাসে। ২৬ শতাংশ যাত্রী এ সমস্যায় আক্রান্ত হন। এর পর রয়েছে মাথাব্যথা, যাতে ভুগতে হয় ২০ শতাংশ যাত্রীকে। এছাড়া ১৫ শতাংশ মানুষ মানসিক চাপ, ১২ শতাংশ শ্রবণশক্তি হ্রাস, ১২ শতাংশ অতিরিক্ত ঘাম, ৯ শতাংশ ক্লান্তি ও ৬ শতাংশ চোখের সমস্যায় আক্রান্ত হয় যানজটের কারণে।
এসব সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার প্রভাবও তুলে আনা হয়েছে সমীক্ষায়। এতে বলা হয়েছে, এসব সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ায় কর্মজীবী মানুষের কাজের প্রতি অনীহা জন্মায়। এতে কর্মীদের উত্পাদনশীলতা হ্রাস পায়, যা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এদিকে যানজটের কারণে গাড়িচালকদের কর্মঘণ্টার প্রায় ২৫ শতাংশ অপচয় হচ্ছে। এতে পথের মধ্যে বসে থেকে ৩০ শতাংশ চালক নানা সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। তিন ধরনের সমস্যা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। এগুলো হলো— মাথাব্যথা, শরীরে ব্যথা ও অতিরিক্ত ঘাম। ফলে চালকদের অর্ধেকই মাথাব্যথায় ভুগছেন।
জানতে চাইলে সমীক্ষা পরিচালনাকারী দলের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর সহকারী অধ্যাপক খালেদ মাহমুদ বণিক বার্তাকে বলেন, যানজটে আটকে থাকা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের ওপর প্রত্যক্ষ জরিপ চালানো হয়। প্রায় এক বছর রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে এ জরিপ চলে। পাশাপাশি উল্লিখিত রোগের কারণে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিত্সা নেয়া রোগী ও সংশ্লিষ্ট চিকিত্সকদের মতামত নেয়া হয়। এর ভিত্তিতে ইকোনমেট্রিক মডেল তৈরি করা হয়। আর প্রাপ্ত ফলাফল তুলনা করা হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) আদর্শ মান ও তথ্যের সঙ্গে।
যানজটে শারীরিক ও মানসিক সমস্যার বেশকিছু কারণ উঠে এসেছে সমীক্ষায়। এতে বলা হয়েছে, যানজটে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় ভোগেন সিএনজিচালিত অটোরিকশার যাত্রীরা। দুদিকে খাঁচার মতো দরজা ও পুরোটা আবদ্ধ থাকায় দীর্ঘ যানজটে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন এ বাহনের যাত্রীরা। এছাড়া যানজটে আটকে থাকা যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়ায়ও অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর মূল কারণ, যানজটে বিভিন্ন যানবাহন চালু রাখা। এছাড়া প্রচণ্ড গরম, যানবাহনের বিশেষত বাসের ত্রুটিপূর্ণ জানালা, ফ্যানের ব্যবস্থা না থাকাও যাত্রীদের শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যার অন্যতম কারণ। এ ধরনের পরিস্থিতি অতিরিক্ত ঘাম, বদহজম ও বমির উদ্রেক করে। আর যানবাহনের কালো ধোঁয়া যাত্রীদের চোখের সমস্যা সৃষ্টি করে।
নিয়মিত যানজটে আটকে থাকা রোগীদের মধ্যে অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও দেখা যায়। আবার যানজটের কারণে অনেকেই কর্মস্থলে পৌঁছতে দেরি করেন। এটি মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। সপ্তাহের পাঁচ কর্মদিবসই দেরিতে কর্মস্থলে পৌঁছানো মানুষের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি। আর যানজটে বিভিন্ন যানবাহন অপ্রয়োজনীয় হর্ন বাজাতে শুরু করে। এতে উচ্চ শব্দে অনেকে মাথাব্যথায় আক্রান্ত হন। এছাড়া নিয়মিত ও লম্বা সময় যানজটে আটকে থাকা ক্লান্তিরও অন্যতম কারণ।
এদিকে সপ্তাহে পাঁচদিন ও দৈনিক ১২ ঘণ্টা করে গাড়ি চালান এমন চালকরা বেশি মাথাব্যথায় ভোগেন। মূলত হর্নের উচ্চ শব্দ এর কারণ।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. রাশিদুল হাসান বলেন, যানজট ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। পাশাপাশি ধুলোবালি তো আছেই। এতে দেশে শ্বাসকষ্টজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। দেড় দশক আগে এ ধরনের রোগীদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ ইনহেলার ব্যবহার করত। এখন সে হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশে। অর্থাত্ বায়ুদূষণের বিরূপ প্রভাব বাড়ছে জনস্বাস্থ্যে। পাশাপাশি অন্যান্য রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। দ্রুত যানজটকে সহনীয় মাত্রায় আনা না গেলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।