যুব চরিত্রের অধোগতি : দেখা দরকার নেপথ্য কারণ

 সৈয়দ মাকসুদ 

শুধু আমাদের বাংলাদেশ নয় এই বিশ্বের প্রতিটা দেশের প্রতিটা মানুষই কোন না কোন বিষয়ে সচেতন। সেটা হতে পারে রোগব্যাধি প্রতিরোধে সচেতনতা, বহিঃশত্রুর আক্রমন থেকে নিজেকে রক্ষা করার সচেতনতা। তেমনি অনেক সচেতনতার মত প্রতিটা দেশের সাংস্কৃতিক বিলুপ্ততা তথা সংস্কৃতির অবমূল্যায়ন ঠেকাতেও সচেতন হতে হয়। বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির হাজার বছরের ঐতিহ্য মন্ডিত সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে আলাদাভাবেই বিবেচনা করতে হয়। ইতিহাসের সূচনা লগ্নথেকেই আমরা বাঙালিদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি যা বিশ্ব পরিমন্ডলে সমাদৃত। জারি-সারি-বাউল-মুর্শিদী-লালন-রবীন্দ্র-নজরুল এসব আমাদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।
আধুনিকায়নের পথ ধরে কালের যুগসন্ধীক্ষনে সময়ের অবধারিত ধারাবাহিকতায় এসেছে পরিবর্তন। স্যাটেলাইটের বদৌলতে এখন ঘরে বসেই বিশ্বের সব চ্যানেল স্যুইচ টিপলেই দেখতে পারা যায়। আর হাতের আশেপাশেই রাস্তার মোড়ে-মোড়ে গজিয়ে উঠা সিডি-ভিসিডি কর্ণারে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের থ্রিলার, যেগুলো দেখে দেখেই আমাদের বর্তমান প্রজন্মের অনেকটা সময় কাটে। আমাদের বর্তমান প্রজন্ম এক কথায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে এসবের। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির নিজস্ব কৃষ্টি-সভ্যতার। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি, নিজের অভিজ্ঞতায় বলছি এখন অনেকে বিরক্তবোধ করেন রবীন্দ্র-নজরুল সংগীতে (এর মধ্যে অনেকে আবার এসবের একনিষ্ট ভক্তও বটে) তারা শুনতে চায় “জেনিফার লোপেজ” “ব্রিটনি পিয়ার্সের” উদ্দাম নৃত্যের সাথে সাথে রগচটা কন্ঠস্বর !!! এরজন্য যে একমাত্র স্যাটেলাইন চ্যানেলগুলো দায়ী তা কিন্তু অবশ্যয়ই নয়, দায়ী আমাদের সমন্বয়হীনতা এবং উগ্র মানসিকতা। এখনকার আধুনিক মায়েরা তার সদ্য কথা বলতে পারা সন্তানকে ঘুম পারানোর আগে শ্রুতিমধুর কন্ঠস্বরে শোনান “টুইংকেল-টুইংকেল লিটল স্টার” এর মতো ইংরেজী কবিতা কিংবা গল্প…. কিন্তু শোনান না “খোকা ঘুমালো-পাড়া জুড়ালো-বর্গী এলো দেশে/বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে”সহ অসংখ্য গল্প-কবিতা যেগুলো শুনলে মুহুর্তেই আকৃষ্ট না হয়ে পারা যায়না। সত্যি অসম্ভব সমন্বয়হীনতা আমাদের খুঁড়ে খুঁড়ে বিনষ্ট করছে। যে শিশুটিকে তার শৈশবেই বিজাতীয় সংস্কৃতির বীজ বপন করে দেয়া হল তার থেকে আর কিইবা আশা করার থাকে আসছে ভবিষ্যতে।
না আমি আধুনিকতার বিরোধী নয় তবে যে আধুনিকতা নিজস্ব কৃষ্টি-সভ্যতা তথা নিজস্বতাকে বিকিয়ে দেয় সে আধুনিকতাকে ঘৃৃনা করি মনে প্রাণে। অন্য কোন ভাষা বিশেষত ইংরেজী ভাষা যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা নয়, তাই এর শব্দগুলোর সঙ্গে জড়িত সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো আমাদের নাড়া দেয়না, বাংলা আমাদের সহজ সাবলীলতা, আপন অনুভূতির সরল এবং সহজবোধ্য প্রকাশ একমাত্র নিজের মাতৃভাষাতেই হয় শতকরা একশত ভাগ, যেখানে আমাদের স্বরূপ উদ্ভাসিত হয় একমাত্র বাংলা সংস্কৃতিতে সেখানে ভিন সংস্কৃতির চাকচিক্যে গা ভাসিয়ে দিয়ে তরুণ প্রজন্ম বিনষ্ট করে চলছি!!! আজ সব স্থানেই চলছে আধুনিকতার নামে উগ্র আধুনিকতা, কি টেলিভিশন-কি চলচ্চিত্র সবখানে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। যার বিস্তারিত বর্ণনা সচেতন মানুষ মাত্রই অবগত আছেন। আপনি পথ চলবেন… দেখবেন দিনকে দিন সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততর হচ্ছে আমাদের নারী সমাজের পোষাক পরিচ্ছদ (মাফ করবেন যারা এর আওতায় পড়েন না) ফলে যা হবার তাই হচ্ছে, সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে যৌন অপরাধসহ নানাবিধ নির্লজ্জ্ব ঘটনার। সনি-সিমি-মহিমা-ফাহিমা-ফরিদা-ছাবিনা-তৃষাসহ অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘিত ঘটনার জন্য যেমন প্রশাসনিক উদাসীনতা অন্যতম প্রধান কারন তেমনি সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বিপদগামীতাও কম দায়ী নয়। এ দায় এড়াতে পারেন না তারাও যারা মিডিয়ায় হর্তা-কর্তা হয়ে কলকব্জা নাড়েন। অশ্লীলতা রোধে বড়বড় বুলি আউড়িয়ে নিজেই অশ্লীলতার রাস্তা প্রশস্থ রাখেন। “থার্টি ফাস্ট নাইট” এর উদ্দামতা “হ্যাপী নিউ ইয়ার” এর উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা “পহেলা বৈশাখ”এর মত বাঙালি উৎসবের আন্তরিকতাকেও উতড়ে যায় অনেকাংশে !!!
নিজের অস্তিত্ব ভুলে গেলে আর থাকেইবা কি তা ভেবে দেখা উচিৎ। আমাদের সবাইকে একটি কথা মনে রাখতে হবে তরুণ প্রজন্ম স্রষ্টা নয় কিন্তু সৃষ্টির হাতিয়ার। তাদেরকে সুশীল-সুন্দর পথ দেখালে শালীনতার আবর্তে শৃংখলিত হবেই, এতে কোন সন্দেহ নাই, কেননা ইতিহাস আমাদের স্বাক্ষ্য দেয় উপর্যুক্ত নির্দেশনা পেলে তরুণ প্রজন্ম কি না পারে। তারুণ্যকে উপর্যুক্তভাবে গড়ে তোলা এবং যথোপযুক্ত নির্দেশনার মাধ্যমে ব্যবহারের দ্বারাই এর কাছ থেকে যা কিছু পাওনা তা আদায় করা যেতে পারে। অতএব জাতীয় যুব চরিত্রের অধোগতির জন্য যুব সম্প্রদায়কে দায়ী করার আগে দেখা দরকার এর নেপথ্য কারন। তবে একটি কথা ভুলে গেলে চলবেনা-সাংস্কৃতিক সচেতনতা অনস্বীকার্য প্রজন্ম সুরক্ষায়।

লেখক :সৈয়দ মাকসুদ, কবি ও সাংবাদিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.