রক্ষা পাবে ২০ কোটি ইলিশ

রক্ষা পাবে ২০ কোটি ইলিশ

ঈদের দিন শুক্রবার থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ১৫ দিনের জন্য নদীতে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ এ সময় ইলিশ ডিম দিয়ে থাকে। এ সময় এক দিন ইলিশ ধরা বন্ধ রাখা সম্ভব হলে এক থেকে দেড় কোটি ইলিশ রক্ষা পায়। তবে এ সময় মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল দেশের উপকূলীয় এলাকার কয়েক লাখ জেলের জন্য বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা হয়নি। এমনকি তাদের আর্থিক সহায়তাও দিচ্ছে না সরকার। এ অবস্থায় এ সময়ে মাছ ধরা থেকে জেলেদের বিরত রাখা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। চাঁদপুর ও ভোলা প্রতিনিধির পাঠানো খবর :

চাঁদপুর : আশ্বিনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে অর্থাৎ ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত মা ইলিশ ডিম ছেড়ে থাকে। ফলে সাগর ছেড়ে উপকূলীয় নদী ও পদ্মা-মেঘনার বিশাল জলরাশিতে ইলিশের ঝাঁক ছুটে বেড়ায়। এ সময় নদীতে জাল ফেলা হলেই প্রচুর পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে মা ইলিশ রক্ষায় বংশ বিস্তারে সরকার ওই সময় মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তবে ১৫ দিন মাছ ধরা থেকে বিরত থাকা জেলেদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়নি।

চাঁদপুরের মতলব উত্তরের ষাটনল থেকে দক্ষিণে হাইমচরের চরভৈরবী পদ্মা-মেঘনার দীর্ঘ ৬০ কিলোমিটার নদীপারের প্রায় ৫০ হাজার জেলেসহ তাদের পরিবারের সদস্যরা মিলে প্রায় দুই লাখ মানুষ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে সরকারি তালিকা অনুযায়ী এ এলাকায় জেলেদের সংখ্যা ৩৩ হাজার ৭০০ জন।

চাঁদপুর জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যে ২৮ হাজার ৯৬৭ জন জেলেকে মার্চ থেকে এপ্রিল এ দুই মাস মাছ ধরা বন্ধের সময় এবং পরবর্তী মে-জুন এ চার মাস মাথাপিছু মাসে ৪০ কেজি হারে চাল দেওয়া হয়। এ ছাড়া ৩১৫ জন জেলেকে বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য এক কোটি ১৫ লাখ টাকার উপকরণ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দেওয়া তালিকার ভিত্তিতে বিকল্প কর্মসংস্থানের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। দরিদ্র অসহায় জেলেদের অনেকেই এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেও নানা রকমের ভয়ভীতির কারণে তারা মুখ খুলতে নারাজ।

এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম জানান, জনপ্রতিনিধিদের তৈরি করা তালিকায় যাদের নাম এসেছে, সেই জেলেদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

চাঁদপুর পৌরসভার পশ্চিম শ্রীরামদী এলাকার জেলে জয়নাল গাজী জানান, নদীতে মাছ ধরে না এমন অনেকেই সরকারি সুযোগসুবিধা পায়। কিন্তু প্রকৃত জেলেরা কিছুই পায় না। পাশের রনাগোয়ালের আরেক জেলে আবদুল হক বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে নদীতে মাছ ধরি। কয়েক বছর ধরে জেলেদের জন্য সরকারি সাহায্য আসে। তবে আমার ভাগ্যে তা জোটে না।’

জেলে আলতাফ হোসেন প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘সামনে ১৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। এই কয়েক দিন পরিবারের সদস্যদের নিয়া কী খাব।’

চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম জানান, ১৫ দিন মাছ ধরা বন্ধের সময় জেলেদের সহায়তা দিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ সময় তাদের ভিজিএফের আওতায় নিতে এক সপ্তাহ আগে অনুরোধপত্র পাঠানো হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এর জবাব পাওয়া যায়নি।

ইলিশ গবেষক ও জাটকা সংরক্ষণ প্রকল্পের পরিচালক ড. আনিছুর রহমান জানান, আগে মা ইলিশ সংরক্ষণের জন্য আশ্বিনের পূর্ণিমায় ১১ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ রাখা হলেও এ বছর তা বাড়িয়ে ১৫ দিন করা হয়েছে। তাতে এক দিনেই এক থেকে দেড় কোটি ইলিশ বেঁচে যাবে।

ভোলা : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোলা জেলায় লক্ষাধিক জেলে নদ-নদী ও সাগরে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। এসব জেলের বেশির ভাগই সরকারের বরাদ্দকৃত ভিজিএফের চাল পাচ্ছে না। কোনো কোনো জেলে আবার সরকারের ওই ভিজিএফের চাল বরাদ্দের কথা জানেও না। সব জেলের তালিকাও মৎস্য অফিসে নেই। জেলা মৎস্য অফিস ও জেলে সমিতির নেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ভোলায় ৮৫ হাজার ৬২০ জন জেলে রয়েছে। এর মধ্যে ৫২ হাজার তালিকাভুক্ত জেলের নামে সরকারের চাল বরাদ্দ আসে। ওই সব জেলের মধ্যেও অনেকে ভিজিএফের চাল পাচ্ছে না।

এ বিষয়ে সরেজমিনে গিয়ে ভোলা সদর উপজেলার মেঘনার পারে কথা হয় বেশ কয়েকজন জেলের সঙ্গে। উত্তর ইলিশা ইউনিয়নের কালুপুর গ্রামের বাসিন্দা জেলে জয়নাল আবেদীন বলেন, প্রায় ১৯ বছর ধরে তিনি বছরে বারো মাস নদীতে মাছ শিকার করছেন। মা ইলিশ রক্ষা, জাটকা নিধনসহ সরকারের বিভিন্ন অভিযান এলেই তারা মাছ শিকার বন্ধ করে দেয়। জাটকা নিধন বন্ধের অভিযানে জেলেদের জন্য সরকার প্রতি বছর চাল বরাদ্দ দেয়। কিন্তু তাঁরা কোনো বরাদ্দ পান না। গত বছরও কোনো চাল পাননি। গত ১৯ বছরে এ ব্যাপারে সরকারের কোনো চাল পাননি।

জেলা ক্ষুদ্র জেলে মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি মো. এরশাদ জানান, ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ১৫ দিনের জন্য নদীতে ডিমওয়ালা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল দুই মাস নদীতে সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ থাকে। নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত আট মাস নদীতে অভিযান চলে। আর সরকার মাত্র চার মাস ভিজিএফের চাল বরাদ্দ দিচ্ছে। এর মধ্যে আবার কেউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। প্রত্যেক জেলের জন্য ভিজিএফের ৪০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হলেও অনেককে ২০-২৫ কেজি করে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এক মাসের চাল আরেক মাসে দেওয়া হচ্ছে। মা ইলিশ রক্ষায় এসব অনিয়ম দূর করা উচিত। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রীতিষ কুমার মল্লিক বলেন, ‘মা ইলিশ রক্ষা অভিযানে জেলেদের জন্য সরকারি কোনো বরাদ্দের চিঠি পাইনি। এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার।’

রুপালি ইলিশ। ছবিটি চট্টগ্রাম থেকে তোলা। ছবি : রবি শংকর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.