রাস্তায় নারী গাড়ি চালকের সংখ্যা বাড়ছে

ঢাকা (বাসস) : ঘনবসতিপূর্ণ এই ঢাকা শহরে রাস্তায় জ্যামের পরিমাণ এতো বেশি যে, চলাচল করাটই প্রায় দুরুহ হয়ে পড়েছে। তারপর রয়েছে গণপরিবহন সংকট। বিশেষ করে নারীর গাড়িতে ওঠা যেন যুদ্ধের শামিল। কিন্তু তাতে তো চলবে না। জীবনের তাগিদে অফিস কিংবা নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতেই হবে। কেন না, রুটি-রুজির জন্য আজ মহিলারাও পুরুষের সমান তালে এগিয়ে চলছে। সড়কের এই বিশাল জ্যামের কারণে অনেক নারীই আজ নিজেই গাড়ি চালিয়ে অফিস করছেন কিংবা নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন। যে কারণে দিন দিন রাস্তায় বাড়ছে নারী গাড়ি চালকের সংখ্যা। অবশ্য এ জন্য পুরুষশাসিত সমাজে একজন নারীকে অনেক সময়ই বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছেন দিয়া।
বাংলা মোটর সিগন্যালের জ্যামে অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে দিয়া। কিছুক্ষণ পর তার গাড়ির পাশে একটি মোটর সাইকেল এসে দাঁড়ালো। মোটর সাইকেলের পেছনে বসা ছেলেটি সামনের জনকে দেখিয়ে বলছে, ওই দ্যাখ্, মাইয়া মানুষ গাড়ী চালায়। এমন কথা শুনলে এখন আর মাথা গরম হয় না। বরং তাদের প্রতি করুণা হয়। গত কয়েক মাস ধরে নিজেই ড্রাইভিং করে অফিসে আসা-যাওয়া করছেন দিয়া। আর এ ক’মাসে হাজারবারের বেশি শুনতে হয়েছে এ কথা।
রাস্তায় মানুষের বিদ্রƒপাত্মক কথা শুনতে হলেও দিয়ার অফিস সতীর্থরা কিন্তু তাকে খুব সাহস যুগিয়েছেন। দিয়া বলেন, প্রথমদিকে রাস্তায় খুব ভয় পেতাম। যতক্ষণ স্টিয়ারিংয়ে থাকতাম, সারাক্ষণ খুব সতর্ক থাকতাম। প্রায় সময়ই মেয়ে ড্রাইভার বলে অনেকেই রাস্তার সাইডে চাপতে চাইতো। বিশেষ করে বাস আর ট্রাকের ড্রাইভাররা তো কখনোই ছাড় দিতে না।
সানজিদা পারুল একজন সংবাদকর্মী। তিনি প্রায় প্রতিদিনই উত্তরা থেকে পুরানা পল্টন অফিসে আসেন স্কুটি চালিয়ে। এ ছাড়াও সপ্তাহের প্রায় তিন থেকে চারদিনই বিভিন্ন এসাইনমেন্ট থাকে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে।
পারুল বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে সাংবাদিকতা করতে এসেছি। কিন্তু বাসা দূরে হওয়ায় আমার অফিসে যাতায়াতে খুব কষ্ট হতো। পরে টাকা জমিয়ে একটা স্কুটি কিনলাম। আজ প্রায় বছরখানেক হলে াআমি স্কুটি চালিয়ে অফিস করছি। শুরুতে ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চালাতে খুব কষ্ট হতো। বিশেষ করে ট্রাক ড্রাইভাররা ফাঁকা রাস্তা পেলে আমাকে রাস্তার একপাশে চাপিয়ে দিতো। যেনো মনে হতো, এই বুঝি আমাকে চাপা দিয়ে দিলো। অনেকবার রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তাদের যেতে দিতাম। তবে এখন অনেক আত্মবিশ্বাষ নিয়ে গাড়ী চালাই।
তিনি বলেন, এখনো আমাদের সমাজের চিন্তা-ভাবনা সেই আগের মতো রয়ে গেছে। অনেকের ধারণা, মেয়েদের নির্দিষ্ট কিছু কাজের বাইরে আর অন্য কিছু করার নেই। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। ঘর আর বাচ্চা সামলিয়েও মেয়েরা এখন এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে।
পারুলের মতে, ঢাকা শহরে সময়ের কাজ সময়ে করতে চাইলে নিজস্ব একটা যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকা খুবই জরুরি। আর স্কুটি এ ক্ষেত্রে ভালো একটি যোগাযোগ মাধ্যম। তার মতে, অফিস সময়ে ঢাকার পাবলিক বাসে উঠতে পারা মানে যুদ্ধ জয় করা। এ সময় কর্মজীবী মহিলাদের কষ্টের সীমা থাকে না।
মূলত এ দেশে ড্রাইভিংয়ে নারীরা নতুন নয়। তবে সংখ্যাটা এখন আগের তুলনায় বেড়েছে। তারপরও তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে অনেক নারীই এখন স্কুটি চালায়। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সূত্রমতে, বর্তমানে মোটর ড্রাইভিং লাইসেন্স গ্রহিতার সংখ্যা হচ্ছে এক শতাংশ।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগে কর্মরত নারী ড্রাইভার সানজিদা খানম বলেন, নারীদের প্রতি আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। আমি যখন প্রথম চাকরিতে যোগদান করি তখন আমার অনেক পুরুষ সহকর্মী আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকাতো। তাদের একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিলো, মেয়ে মানুষ আবার ড্রাইভিং করে নাকি! কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আমি তাদের ধারণা পাল্টে দিয়েছি। এমনকি তাদের অনেকেই এখন আমাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে।
এদিকে, সুমনার গল্পটা কিছুটা ভিন্ন। তার বাবা ছিলেন একজন ড্রাইভার। প্রায় সময়ই তিনি দুপুরে বাসায় খেতে আসার সময় তার বসের গাড়ীটি নিয়ে আসতেন। এ সময় সুমনা খুব বায়না ধরতো সেও গাড়ী চালানো শিখবে। বাবাও তাকে খুব আদর করে গাড়ী চালানো শিখিয়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম। এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার বাবা মারাত্মক আহত হন। সেই থেকে তিনি আর বিছানা থেকে উঠতে পারেন না।
তখন পরিবারের বড় হিসেবে সুমনার কাঁধেই চলে আসে পুরো সংসারের দায়িত্ব। অনেক চেষ্টা করেও কোন চাকরি যোগাড় করতে না পেরে সুমনা সিদ্ধান্ত নেয় সেও তার বাবার মতো গাড়ী চালাবে। চলে যায় তার বাবার অফিসে। তারাও খুব আন্তরিক হয়ে সুমনাকে তার বাবার চাকরিটি দিয়ে দেয়। তারপর থেকে আজ দু’বছর হতে চললো সুমনা ড্রাইভিং করছে।
মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট মনোয়ারা বেগম বলেন, আমরা আসলে আমাদের সমাজে নারীদের একভাবে দেখতে অভ্যস্ত। আমাদের বদ্ধমূল ধারণা হচ্ছেÑ নারীরা স্বামী, সংসার আর বাচ্চা সামলাবে। কিন্তু দিন পাল্টে গেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া কখনোই একটি রাষ্ট্র উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.