শিক্ষিকার জামিনেই যেন শেষ না হয়
হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী ।
আমাদের দেশটা অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনার দেশ। তবে মজার বিষয় হলো, ঘটনা যত বড়ই হোক, আমাদের সাময়িক উত্তেজনা প্রশমন হতে না হতেই আরেকটি ঘটনা এসে সেটিকে চাপা দিয়ে যায়। আবার এমনও হয়, আমরা নিজেরাই ক্লান্ত হয়ে ঘটনাটি ভুলে যেতে চাই। এর ফল হয় এই, সমস্যা যে তিমিরে, সে তিমিরেই থেকে যায়।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা হাসনা হেনার জামিন লাভের মধ্য দিয়ে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এর মানে এই নয় যে, শিক্ষিকা হাসনা হেনার জামিন লাভের আমরা বিরোধী। একজন শিক্ষিকা কারাগারে থাকবেন, এটা কোনো বিবেকবান মানুষই চাইতে পারেন না। আমরাও চাই না। কিন্তু কখনো কখনো পরিস্থিতির দাবিতে সাবেক মন্ত্রী, ডাকসাইটে আইনজীবী, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদকে যেমন কারাগারে যেতে হয়, তেমনি শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও কখনো কখনো কোনো ঘটনার শিকার হতে হয়। যেমন ভিকারুননিসার ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলায় গ্রেফতার হতে হয়েছিল শিক্ষিকা হাসনা হেনাকে।
অরিত্রীর আত্মহননের পর বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল ভিকারুননিসা স্কুল। আন্দোলনে নেমেছিল ছাত্রী ও অভিভাবকরা। তাদের দাবি ছিল অরিত্রীর আত্মহননের জন্য দায়ীদের বিচার। এর সূত্র ধরে প্রধানশিক্ষিকাসহ তিন শিক্ষিকার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। গ্রেফতার করা হয় এক শিক্ষিকা হাসনা হেনাকে। এর পর আবার পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। এবার একদল শিক্ষার্থী দাবি জানাতে থাকে গ্রেফতারকৃত শিক্ষিকার মুক্তি। অবশেষে তাও মানা হয়।
এখন আমরা কি মনে করবো, ঘটনার ‘তামাম শোধ’?
আসলে অরিত্রীর আত্মহননের মধ্য দিয়ে আমরা একটি বিশাল সমস্যার চূড়াটুকু দেখতে পেয়েছি। এ ঘটনার পর ভিকারুননিসার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বক্তব্য এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অসংখ্য প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা জেনেছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে এক শ্রেণির (সবাই নন) শিক্ষক কী ধরনের আচরণ করে থাকেন। তাদের অনেকেই (আবারো বলছি, সবাই নন) ভর্তিবাণিজ্য, কোচিংবাণিজ্য ইত্যাকার নানা অপকর্মে জড়িত তো থাকেনই, এমনকি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মানবিক আচরণের ন্যূনতম সৌজন্যটুকুও দেখান না তারা।
একজন কোমলমতি শিক্ষার্থীর মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার পেছনে পরিবারের ভূমিকা ও দায়িত্ব অবশ্যই আছে। কিন্তু তার চাইতে বেশি দায়িত্ব আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের। কারণ একজন শিক্ষার্থী দিনের বেশিরভাগ সময় থাকে শিক্ষকদের সাহচর্যে। শিক্ষকের আচার-আচরণ, কথাবার্তা তাদেরকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে থাকে। এ অবস্থায় শিক্ষকদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত সেটা বলাই বাহুল্য।
অরিত্রীর আত্মহননের ঘটনাটা মূলত শিক্ষকদের লাগামছাড়া আচরণেরই ফল। তারা মেয়েটির অপরাধের জন্য অভিভাবককে তলব না করে সহৃদয় আচরণের মাধ্যমে মেয়েটিকে তার ভুল ধরিয়ে দিতে পারতেন। অভিভাবককে যখন ডাকাই হলো তখন তাদের সাথেও ভদ্র আচরণ করাই কাম্য ছিল। কিন্তু ‘শিক্ষকরা’ এর ধারেকাছে না গিয়ে যা করলেন, তাকে শুধু অভদ্রতা বললেই হয় না, বলতে হয় চূড়ান্ত অমানবিকতা। আর এই অমানবিকতার করুণ ফল হলো একটি তরুণ তাজা প্রাণের আত্মাহুতি।
শিক্ষকদের কাছে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, গ্রেফতারকৃত শিক্ষিকা জামিন পেয়ে গেছেন, আপনাদের মামলাও একদিন শেষ হবে, কিন্তু অরিত্রী কি আর কোনোদিন ফিরে আসবে?
অরিত্রী আর ফিরে আসবে না – আমরা জানি। আমরা চাইলেও আসবে না। তাই তা আর চাইও না। কিন্তু শিক্ষকরা মানবিক ও ভদ্র হবেন, এটা তো চাইতে পারি!
আবারো বলছি, সব শিক্ষক শিক্ষাব্যবসায়ী – এমন কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। আমরা তা বলছিও না। কিন্তু অরিত্রীর আত্মহনন আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, সব শিক্ষক পরিপূর্ণ শিক্ষক নন। শিক্ষকের প্রয়োজনীয় গুণাবলী ছাড়াই অনেকে শিক্ষক পদে ঢুকে পড়েছেন।
শিক্ষাঙ্গনে মানবিকতাবিহীন কারো উপস্থিতি আমাদের ভবিষ্যতকেই বিনষ্ট করবে। আজ সময় এসেছে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিবিড় জরিপ চালিয়ে এরকম শিক্ষকদের চিহ্নিত এবং কাউন্সেলিং করা।
কেউ কি আছেন, কাজটি করার?
হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী: সাংবাদিক