শীতের বিকেল কাটুক লালবাগ কেল্লায়

ঢাকা: ‘রঙ পেন্সিলের শিশিটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা। মুহুর্ত কয়েক পর কিছু একটা ভেবে শীতল হাওয়াতে জেগে ওঠা। এবার স্মৃতির পাতাতে তুলিরা আঁচড় কেটে চলে অবিরাম। লালবাগ কেল্লায় বিকেলের সোনা রোদের মোলায়েম স্পর্শে রঙিন হয় ফরহাদ-জিনিয়ার ক্যানভাস। এই সবুজ ঘাসের বুকে এক শীতের বিকেলে রসায়ন ঘটেছিল ওদের প্রেমের। গত হয়েছে কয়েক বসন্ত, প্রথম দেখার স্মৃতিকে অমর করে রাখতে প্রায় ঘুরে যায় ফরহাদ তার জিনিয়াকে নিয়ে লালবাগ কেল্লায়’। পরিচয় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মোঘল আমলের নিদর্শন লালবাগ কেল্লা। কষ্টি পাথর, মার্বেল পাথর আর নানা রঙ বেরঙের টালি দিয়ে কারুকাজ করা এক ঐতিহাসিক সৃষ্টি লালবাগ কেল্লা। প্রথমে এর নাম ছিল কেল্লা আওরঙ্গবাদ। নকশা করেছিলেন শাহ আজম। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব পুত্র শাহ আজম ইংরেজি ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার সুবেদারের বাসস্থান হিসাবে এই দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। এর পরের বছর ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে মাত্র এক বছরে একটি মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পর দুর্গ নির্মানের কাজ থেমে যায়। বাংলার নবাব শায়েস্ত খাঁ ১৬৮০ খ্রিস্টব্দে ঢাকায় এসে পুনরায় এর নির্মান কাজ শুরু করেন। তবে শায়েস্তা কন্যা পরীবিবির অকাল মৃত্যুতে এই স্থাপত্যকে অপয়া-অলক্ষ্মী মনে করা হয়। সে কারণে এর নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। শোনা যায় সম্রাট পুত্র শাহ আজমের সঙ্গে পরীবিবির বিয়ে হবার কথা ছিল। মৃত্যুর পর পরীবিবিকে দরবার আর মসজিদের ঠিক মাঝখানে সমাহিত করা হয়। পরবর্তিতে শায়েস্তা খাঁ দরবার হলে রাজকাজ পরিচলনা করতেন বলে জানা যায়। শায়েস্তা খাঁ ঢাকা ছেড়ে আগ্রা চলে গেলে নানা কারণে এই লালবাগ কেল্লার গুরুত্ব কমতে থাকে। ১৮৪৪ সালে ঢাকা কমিটি নামে একটি আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান এর উন্নায়নের কাজ শুরু করেন। এ সময় লালবাগ দুর্গ নামে এর পরিচিতি লাভ করে। ১৯১০ সালে লালবাগ দুর্গের প্রাচীর সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসাবে প্রত্নতত্ত বিভাগের অধীনে আনা হয় যা নির্মাণের পর প্রথম আশির দশকে দুর্গের যথাসম্ভব সংস্কার করে আগের রূপে ফিরিয়ে আনা হয় এবং দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। যা কিছু সুন্দর ‘যাহা দেখিবে চক্ষু মেলিয়া, যাহা দেখিবে হৃদয় খুলিয়া তাহায় লাগিবে ভালো’ লালবাগ কেল্লা মোঘল আমলের একটি চমৎকার নিদর্শন। প্রশস্ত এলাকা নিয়ে লালবাগ কেল্লা অবস্থিত। হাজারো চেনা অচেনা ফুলে সুশোভিত চারিদিকে সবুজের হাতছানি। ছোট বড় মানানসই গাছের উপস্থিতি, সবুজ ঘাসে মোড়া বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ, দেখে মনে হবে এক-টুকরো স্বর্গ। কেল্লার চত্তরে মূল তিনটি স্থাপনা রয়েছে- * কেন্দ্রস্থলের দরবার হল ও হাম্মাম খানা * পরীবিবির সমাধি * উত্তর-পশ্চিমের শাহী মসজিদ এছাড়া দক্ষিণ-পুর্বের সুদৃশ্য ফটক এবং দক্ষিণ দেয়ালের ছাদের উপরের বাগান। দেয়ালের পাশেই তরুণী দর্শনার্থী জেনি ক্যাথরিনের (২০) সঙ্গে কথা হল, তিনি ঢাকার ফার্মগেট থেকে পরিবার নিয়ে এসেছে একটু অবসর উপভোগ করতে। কথা বলে জানা যায় প্রায় এখানে বন্ধুদের নিয়ে কিংবা প্রেমিকার হাত ধরে চলে আসে এই সবুজ ঘাসের তাজমহলের টানে। এখানে সে অন্যরকম এক স্বর্গের সুখ অনুভব করে। পরীবিবির মাজারের কাছে গিয়ে কথা হল জাহিদ-মুক্তা জুটির সঙ্গে। সদ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা শুরু করা এই রোমিও জুলিয়েট জুটি হাসতে হাসতে জানান, ‘ওর জন্য তাজমহল বানাতে তো পারবো না তাই বাংলার তাজমহল দেখতে এসেছি’। ঢাকার এই যানজটের তীব্র যন্ত্রণা ভুলে শীতের বিকেলে তারা এখানে এসেছে। শতাধিক দর্শনারর্থীর ভিড়ে একটাই প্রচেষ্টা- পড়ন্ত বিকেলে লালবাগ কেল্লার ছবি হৃদয়ে ক্যানভাসে আঁকা। কখন যাবেন ‘ঐ রূপ যখন স্বরণ হয় থাকে না বাঁধা বিপদের ভয়’ ডেটিং কিংবা চ্যাটিং, রোমিও জুটি কিংবা পরিবার আত্মীয় নিয়ে চলে আসতে পারেন শীতের কোনো এক বিকেলে। দিনশেষে হালকা বাতাসে দুলিয়ে চুল কিংবা শাড়ির আঁচল উড়িয়ে বধুর হাতে রেখে হাত নতুন দিনের স্বপ্ন বুনতে পারে ক্লান্ত স্বামী। শীতের হালকা শীতল দুর্বার বনে ঘুরতে পারেন অপরূপ এই মোঘল ঐতিহ্যের স্বর্গে । সময়সূচি লালবাগ কেল্লার সময়সূচি বছরে ২বার পরিবর্তন হয়ে থাকে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে বৃহস্পতি থেকে শনিবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। তবে দুপুর ১টা থেকে ১টা ৩০ পর্যন্ত বিরতি থাকে। শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১২টা এবং দুপুর ২টা ৩০ থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। এছাড়া সোমবার অর্ধ দিবস দুপুর ২টা ৩০ থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। অক্টোবর থেকে মার্চ মাসে বৃহস্পতি থেকে শনিবার সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত তবে দুপুর ১টা থেকে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বিরতি। শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে ১২টা ৩০ পর্যন্ত এবং ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এছাড়া সোমবার দুপুর ১টা ৩০মিনিট থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। কর্মব্যস্ত ক্লান্ত ঢাকার বিকেলটা কাটতে পারে লালবাগ কেল্লায়। নরম ঘাসে পা রেখে হাঁটার সুখ আর বুক ভরে খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেয়ার এ শান্তি সত্যিই অকৃত্রিম। জায়গাটি বিশেষ করে ছোট্ট ফ্ল্যাটে বন্দি বাচ্চাদের খেলার জন্য উন্মুক্ত উদ্যান বলতে পারেন। আপনিও ঘুরে আসতে পারেন এই শীতের বিকালে এক দণ্ড শান্তি, নিরবতা আর সুখের খোঁজে মোঘল এই স্থাপনায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.