সংযত মুদ্রানীতি ও ব্যাংকে অলস টাকা -আবদুল বাকী বাদশা

সুদের হার কমিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী ছয় মাসের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন এই মুদ্রানীতির নাম দিয়েছে ‘সংযত কিন্তু সমর্থনমূলক মুদ্রানীতি’। যেকোনো পদ্ধতিতেই হোক না কেন, বিনিয়োগ বাড়ানোর মূল কৌশল নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান পরবর্তী ছয় মাস অর্থাৎ জানুয়ারী-জুন মাসের জন্য ‘উৎপাদন ও মূল্য পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে সংযত কিন্তু সমর্থনমূলক মুদ্রানীতির ঘোষণা দেন। গভর্নর বলেন, ‘এবার প্রথমত, আমরা সুদহার কমিয়েছি। বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রেপো ও রিভার্স রেপো হার ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে যথাক্রমে ৬ দশমিক ৭৫ ও ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ব্যাপক মুদ্রা ও বেসরকারি খাতে ঋণ জোগানের প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপিত হয়েছে যথাক্রমে ১৫ ও ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এটি আগের মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সামান্য কম, তবে প্রকৃত অর্জনের চেয়ে যথেষ্ট বেশি।’ ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘যথাযথ ঋণ জোগান ও ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে আমাদের এই নীতি পুনঃসমন্বয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো বিঘ্ন ঘটাবে না। আর কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য যথেষ্ট হবে বলে আমরা মনে করি।’ বর্তমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে চলতি অর্থবছর শেষে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশও স্পর্শ করতে পারে বলে মনে করেন গভর্নর।
মুদ্রানীতির সবদিক বিবেচনা করলে বলা যায় মাননীয় গভর্নর অত্যন্ত আন্তরিকতা ও বাস্তবতার বিবেচনাতেই চাচ্ছেন দেশে বিনিয়োগ বাড়ুক এবং তরুনদের কাজের পরিধিও বাড়ৃক, কারণ বিনিয়োগ বাড়লেই কর্ম সংস্থানের পরিধি এমনিতেই বাড়বে, অর্থনীতিতে প্রাণ ফিরে আসবে বা অন্যভাবে বললে বলা যায় মানুষের কর দেয়ার সক্ষমতাও বাড়বে।এ ব্যাপারে তার একটি ব্ক্তব্যের ইতিবাচক বিশ্লেষণের দাবি রাখে, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টিতে তরুণদের অবদানের কথা তুলে ধরে গভর্নর বলেন, আশার কথা, আমাদের তরুণ কর্মক্ষম জনশক্তির সুবিধা, দ্রুত বিকাশমান মধ্যবিত্তের চাহিদা, প্রযুক্তি গ্রহণে তাদের সদা প্রস্তুতি, বাড়ন্ত বাজার পরিধি ও জনসংখ্যার ঘনত্ব আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ইঞ্জিনটিকে দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই সামনের দিনগুলোয় এ দুই ইঞ্জিনের মধ্যে অভ্যন্তরীণ চাহিদার ইঞ্জিনটিকে আরো শক্তিশালী করাকেই বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। সেজন্য আমাদের জাতীয় সঞ্চয়ের হার আরো বাড়াতে হবে এবং সেই সঞ্চয়কে উৎপাদনশীল খাতে বেশি করে বিনিয়োগ করতে হবে।
বাস্তবতার নিরিখে তিনি তিনি যে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেছেন তার বাস্তবায়নই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, সত্যি কথা বলতে কি এখন ব্যাংকগুলোতে হাজার হাজার বা লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের অভাবে অলস পড়ে আছে, যারফলে বিনিয়োগ বাড়ানো যাচ্ছে না, তরুণ তরুণী বা যুব সমাজের মধ্যে ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা হবার প্রচেষ্টার বদলে চাকরির পেছেনে ছুঁটে চলার প্রবনতা বাড়ছে দিন দিন, এদের যদি ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা হবার দিকে ধাবিত করা যায় তবে তাহলে তারা নিজেরাই নিজেদের কাজের ব্যবস্থা করতে পারবে এবং অন্যদেরও কাজ দিয়ে বেকারত্ব হ্রাস করতে পারবে। তারপর একজন যদি নতুন ব্যবসায়ী বা শিল্প উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয় তবে তার দেখাদেখি অন্য আরেক জনও এ দিকটায় আগ্রহী হয়ে উঠে। মানুষের যদি আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয় তবে অর্থনীতির অন্যান্য খাতও এতে প্রভাবিত হয়। একটু পিছনের দিকে ফিরে তাকালেই দেখা যাবে – গত ক বছরে আমাদের দেশের দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ নেতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। রাজনৈতিক অস্তিরতার কারণে হয়তো প্রত্যাশিত বিদেশী আসেনি কিন্তু ব্যাংকগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে থাকার পরও কেন প্রত্যাশিত বিনিয়োগ হয়নি তা অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের খতিয়ে দেখা উচিত। আমার মনে হয় বাংলাদেশ ব্যাংক যদি দেশের ব্যাংকগুলোকে নতুন বিনিয়োগ করার ব্যাপারে বাধ্যতামূলক নির্দেশনা জারি করে তবে তা অনেক সুফল বয়ে আসবে।
এর আগে গত বছরের জুলাইয়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে আগামী জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ করা হয় ১৫ শতাংশ। গত নভেম্বর পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। আর নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এ প্রক্ষেপণ গত মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হলেও প্রকৃত অর্জনের চেয়ে বেশি। এত দেখা যায় গত মুদ্রানীতিতেও ঋণ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রায় অর্জিত হয়নি। যকটুকু হয়েছে তার অধিকাংশই বড় বড় শিল্পপতি বা অন্যান্যরা নিয়েছেন নতুন বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এ সুয়োগ খুবই কম পেয়েছেন।

দেশের বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে, দেশে এখন এক অস্বাভাবিক রাজনৈতিক নিরবতা বিরাজ করছে, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের রাজনৈতিক মহলকেই এগিয়ে আসতে হবে। অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হয়, এমন কোনো অবস্থা আমাদের কারো জন্য কাম্য হতে পারে না। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকা- বিবেচনা করলে খালি চোখেই দেখা যায়, বিনিয়োগ স্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে না, অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়ছে নেতিবাচক হারে এবং নতুন কর্মসংস্থান বাড়ছে না আশানুরূপভাবে।
একটি জাতীয় দৈনিকে সম্প্রতি খবর বেরিয়েেছ, ব্যাংকগুলোতে অলস পড়ে আছে ৯০ হাজার কোটি টাকা। খবরটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক, কারণ ব্যাংকগুলোয় হাজার হাজার কোটি টাকা পড়ে আছে, মানে দেশে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে গেছে। ব্যাংকগুলো আমানত নিরুৎসাহী করতে সুদের হার ক্রমাগত কমাচ্ছে। এই কিছুদিন আগেও ব্যাংকগুলো যেখানে স্থায়ী বা নির্দিষ্ট আমানতের ওপর প্রায় ১০ শতাংশ হারে লাভ দিত, তারা এখন সেই লভ্যাংশ প্রদানের পরিমাণ কমিয়ে আনছে ৭ শতাংশের নিচে। ব্যাংকগুলো যদি কম সুদে আমানত নিয়ে বিনিয়োগকারীদেরও কম সুদে ঋণ দিতো তাহলে বলার কিছু ছিলো না, তবে বিশেষকরে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখনও উচ্চ হারে ঋণ বিতরণ করছে। এ ব্যাপারে বাংলাধেম ব্যাংকের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধস দেশের লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে সর্বস্বান্ত করে পথে বসিয়ে দিয়েছিল। সেই দুস্থ ক্ষত আজও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের, ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সরকার বেশকিছু প্যাকেজ পদক্ষেপ আগেও নিয়েছিল এবং এবারও নিয়েছে, তবে কথা থেকেই যায় বাস্তবেই কি এবার তারা সত্যি সত্যি সুবিধা পাবে।

অপরদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চারটি ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকে তাদের দ্বায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করতে পারছে কিনা সেটাও এখন নিয়মিত মনিটরিং এর মধ্যে রাখা উচিত।

একসময় বিনিয়োগের শ্রেষ্ঠ জায়গা ছিলো দেশের আবাসন খাত, কিন্তু মহল বিশেষের অসহযোগিতা ও অদক্ষতার কারণে এ খাত আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আবাসন খাতে ধস, অবকাঠামো উন্নয়ন কাজে স্থবিরতা ও লোহার কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম বৃদ্ধির কারণেই রডের বিক্রির পরিমাণও কমে গেছে বলে জানা গেছে। গত তিন মাস ধরেই নাকি দেশের সব ধরনের লোহা ও রডের চাহিদা কমে যাওয়ায় প্রতিটি রিরোলিং মিল ও শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে লাখ লাখ টন লোহার কাঁচামাল অবিক্রীত পড়ে আছে।
আবাসনশিল্প নিয়ে যারা একটু খোঁজখবর রাখেন, তারা সবাই জানেন, আজ প্রায় পাঁচ ছয় বছর থেকে এ খাতটি প্রায় ধুঁকে ধুঁকে মরতে বসেছে। যে আবাসন শিল্পে প্রায় লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করত, তাদের অনেকেই আজ বেকার বা পেশা বদল করার চেষ্টা করছে।
বিনিয়োগের এমন অনেক ক্ষেত্রেই চলছে এমন অরাজকতা, কোথাও নেই সংকট সমাধানের কোনো উপায় বের করার চেষ্টা বা দিকনির্দেশনা।
যেখানে দেশের লাখ লাখ প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন বেকার, প্রতিবছর যেখানে হাজার হাজার তরুণ নতুন শ্রমবাজারে যোগ দিচ্ছে, যেখানে ব্যাংকগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে সেখানে নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা কতটুকু উপকৃত হেই সেটাই এখন দেখার বিষয়।
badsha7991@yahoo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.