সম্পদের প্রাচুর্য মানব মল-মুত্রেও!
আহমদ গিয়াস
প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনায় বর্জ্য আ অপচয় বলে কিছু নেই, যদি যথাস্থানে যথাযথভাবে ওই বর্জ্যরে ব্যবহার হয়। প্রকৃতিতে অন্যান্য প্রাণীর বর্জের মতোই মানুষের মল-মুত্রও মহা মূল্যবান। প্রতি একর জমিতে সারা বছরের চাষবাসের জন্য মাত্র ১০ জনের মুত্রই সার হিসাবে যথেষ্ট। মানবমুত্র দিয়ে মাছের হরমোন ও জৈব ইট তৈরিও করা হচ্ছে। আর মানুষের মল থেকে বায়োগ্যাসের মাধ্যমে উৎপাদন করা হচ্ছে বিদ্যুৎ, যেখানে গড়ে ১ জন মানুষের মল থেকে আসছে ৬৫.২৯ ওয়াট বিদ্যুৎ/ ২৪ ঘন্টা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষণায় লব্ধ এ কৌশলগুলো আমরাও কাজে লাগিয়ে কক্সবাজার শহরে ১৩ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৬৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন, চট্টগ্রাম শহরে প্রায় ৩শ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ও রাজধানী ঢাকায় প্রায় ১২শ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে ওঠতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকরা। পাশাপাশি বিকল্প সার হিসাবেও মানব মল-মুত্রের ব্যবহার বাড়িয়ে রাসায়নিক সারের উপর আমদানী নির্ভরতা দুর করা যায় বলে মনে করছেন তারা।
মানুষের টাটকা মলে প্রায় ৭৫% জল থাকে এবং বাকী কঠিন অংশটির ৮৪-৯৩% জৈব দ্রব্য হয়। আর এই জৈব সলিডগুলির মধ্যে ২৫% থেকে ৫৫% পর্যন্ত ব্যাকটিরিয়া বায়োমাস, ২% থেকে ২৫% পর্যন্ত প্রেটিন বা নাইট্রোজেনাস পদার্থ, ২৫% কার্বোহাইড্রেট বা অপরিশোধিত উদ্ভিদ পদার্থ এবং ২% থেকে ১৫% পর্যন্ত চর্বিযুক্ত দ্রব্য থাকে। মানুষের মল থেকে উৎপন্ন হওয়া বায়োগ্যাসকে টারবাইনের মাধ্যমে বিদ্যুতে রূপান্তর করে একটি বাড়ি, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি সমাজ, একটি শহর কিংবা পুরো একটি দেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে বলে জানান বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী ও ভ‚-রসায়নবিদ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী।
তিনি জানান, ইন্দোনেশিয়ায় বায়োগ্যাস ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ১০ হাজার মানুষের মল থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬৫২.৯৭ কিলোওয়াট হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সে হিসাবে কক্সবাজার শহরের ২ লাখ অধিবাসীর মানব বর্জ্য বা মলকে কাজে লাগিয়ে ১৩ মেগাওয়াট ক্ষমতাস্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র, উখিয়া-টেকনাফে ১০ লাখ রোহিঙ্গার উপর ভিত্তি করে ৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম মহানগরীর অধিবাসীদের উপর ভিত্তি করে ৩শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং রাজধানী ঢাকা মহানগরীর অধিবাসীদের উপর ভিত্তি করে ১২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে ওঠতে পারে। আবার বায়ো গ্যাস প্রকল্পের বর্জ্যগুলো জৈব সার হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আর এই জৈব সার, বাজারে প্রচলিত রাসায়নিক সারের চেয়ে অনেক শক্তিশালী বলেও গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
গবেষকদের মতে, মানুষ প্রতিদিন ১শ গ্রাম থেকে ৪শ গ্রাম পর্যন্ত মলত্যাগ করে। যেখানে ৩০ থেকে ৬০ গ্রাম পর্যন্ত থাকে শুষ্ক পদার্থ। এ শুষ্ক পদার্থে ২৪% কার্বন থাকে। আবার কার্বন এর প্রায় ৬০% হল কার্বন বায়োহাইড্রেইট, কার্বন বায়োগ্যাসের ৫৩% হল মিথেন।
নেপালের বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁ মানব মলসহ অন্যান্য বর্জ্যকে বায়োগ্যাসে রূপান্তর করে নিজেদের শতভাগ বিদ্যুৎ চাহিদা পুরণের পাশাপাশি রান্না-বান্নার প্রয়োজনও মেটাচ্ছে বলে জানান ড. আশরাফ আলী সিদ্দ্কিী। কক্সবাজারের হোটেল-মোটেলগুলোও নেপালের অনুসরণে লাভবান হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
ড. আশরাফ সিদ্দিকী বলেন, বায়োগ্যাস প্রকল্প থেকে বাই প্রোডাক্ট হিসাবে যে জৈব সার আসবে তা দিয়ে কক্সবাজারের হাজার হাজার একর কৃষি জমির সারের চাহিদাও মিটবে।
মানবমুত্রও একটি শক্তিশালী বিকল্প সার, যাকে একটি ‘তরল সোনা’ হিসাবে বর্ণনা করছেন বিজ্ঞানীরা। মানবমুত্র বিকল্প সার হিসাবে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। আবার মানবমুত্র দিয়ে মাছের হরমোন ও জৈব ইট তৈরিও করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এক একর জমির ফসল উৎপাদনের জন্য সারা বছরে মাত্র ১০ জন লোকের প্রস্রাবই যথেষ্ট। সে হিসাবে কক্সবাজার শহরের অধিবাসীদের মুত্র থেকে ২০ হাজার একর, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অধিবাসীদের মুত্র থেকে ১ লাখ একর, চট্টগ্রাম শহরের অধিবাসীদের মুত্র থেকে সাড়ে ৪ লাখ একর এবং ঢাকা শহরের অধিবাসীদের মুত্র থেকে ১৮ লাখ একর জমির চাষবাস সম্ভব।
মানব মুত্র উদ্ভিদের প্রধান খনিজ, যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম ও আরো উপাদানগুলির একটি দুর্দান্ত উৎস। প্রস্রাবকে সার হিসাবে ব্যবহার নিয়ে বিশ্বকে পথ দেখানো উগান্ডার কাওন্দা কৃষি গবেষণা সংস্থার মাটি বিজ্ঞানী প্যাট্রিক মাখোসি সার হিসাবে মানব মূত্রের কার্যকারিতা নিশ্চিত করে বলেছেন যে, প্রতি সপ্তাহে একবার করে কমপক্ষে দুই মাস ধরে শাকসব্জির বাগানে প্রস্রাব প্রয়োগ করলে ফলন দ্বিগুণ হবে।
মানবমুত্রে সাধারণত: ৯৫% জল থাকে। বাকী উপাদানগুলির মধ্যে ইউরিয়া, ক্লোরাইড, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্রিয়েটিনিন এবং অন্যান্য দ্রবীভূত আয়ন ও জৈব-অজৈব যৌগগুলি রয়েছে। ইউরিয়া হ’ল একটি অ-বিষাক্ত অণু যা বিষাক্ত অ্যামোনিয়া ও কার্বন ডাই অক্সাইড এর রাসায়নিক মিশ্রনে তৈরি হয়।
মাছের এইচসিজি হরমোন তৈরীতে প্রস্রাব
মানুষের মুত্র থেকে মাছের জন্য হিউম্যান করিওনিক গোনাডোট্রোপিন (Human chorionic gonadotropin) হরমোন তৈরি হচ্ছে। এটি HCG হরমোন নামেও বাজারে পরিচিত। এটি মূলত গর্ভবতী নারীদের প্রস্রাব থেকে তৈরি হয় বলে জানান বিশিষ্ট সামুদ্রিক মৎস্য বিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ ফিশারিজ রিচার্স ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক।
তিনি জানান, এই এইচসিজি হরমোন হ্যাচারীতে পোনা তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। মা মাছের ডিম ধারণ, পরিপক্কতা লাভ ও ডিম ছাড়তে উদ্বুদ্ব করার জন্য এই হরমোন উদ্দীপক হিসাবে কাজ করে। এখানে থাকা ডোপামিন মা মাছকে প্রজননে উদ্বুদ্ব করে।
বায়োব্রিকস বা জৈব ইট তৈরীতে প্রস্রাব
২০১২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ছাত্ররাই মানব মূত্র থেকে বিশ্বের প্রথম ইট তৈরি করে। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বায়ো-ইট জন্মানোর জন্য ইউরিয়া ব্যবহারের ধারণাটি সিন্থেটিক পণ্য ব্যবহার করে পরীক্ষা করা হয়েছিল। তবে ইউসিটি ছাত্র সুজান ল্যামবার্টই প্রথম ইট তৈরির জন্য প্রকৃত মানব প্রস্রাব ব্যবহার করেন। মাইক্রোবাইয়াল কার্বনেট নি:সরণের মাধ্যমে একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে এই জৈব-ইট তৈরি করা হয়, সমুদ্রের কূপগুলি যেভাবে তৈরি হয় তার মতো। যেখানে সাধারণ ইট তৈরিতে ১৪০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার দরকার এবং যার কারণে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়; মানব মূত্র থেকে জৈব ইট (বায়োব্রিকস) তৈরির জন্য আগুণের সংস্পর্শ দরকার হয় না, কেবল জৈব রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটিয়ে ইট তৈরি করা হয়। যেটি সাধারণ চুনাপাথরের তুলনায় ৪০% বেশি শক্তিশালী এবং জৈব রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই ইট দিনদিন আরো শক্তিশালী হয় বলে দাবী করেন গবেষকরা।
কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইঞ্জিনিয়ারিং ভবনে বিশেষভাবে নকশা করা পুরুষ মূত্র থেকে প্রস্রাব সংগ্রহের মাধ্যমে এটি বালি ও ব্যাকটেরিয়ার সাথে মিশ্রিত করে জৈব-ইট তৈরি করেন।
সারের বিকল্প হিসাবে প্রস্রাব ব্যবহারে কক্সবাজারের দরিয়ানগরে সমীক্ষা
কক্সবাজার শহরতলীর দরিয়ানগরে সারের বিকল্প হিসাবে প্রস্রাবের ব্যবহার নিয়ে একটি ব্যক্তিগত সমীক্ষা চালানো হয়। যেখানে বিভিন্ন জাতের বাঁশ ও ফলজগাছে মানব প্রস্রাব প্রয়োগ করে বিস্ময়কর ফলাফল পাওয়া যায়। প্রস্রাব প্রয়োগ ও প্রয়োগবিহীন পেঁপে গাছে স্বাদের ব্যাপক তারতম্য ছিল। প্রস্রাব প্রয়োগ করা গাছের পেঁপে অনেক বেশি মিষ্টি ছিল। আর বাঁশ ঝাড়ে খড়ের বা শুকনো পাতার উপর প্রস্রাব প্রয়োগ করেই অপেক্ষাকৃত ভাল ফলাফল পাওয়া গেছে। তবে বাঁশঝাড়ে প্রস্রাব প্রয়োগের সময় চারগুণ পানি মিশিয়ে ও ফলজ গাছে ১০/১৫ গুণ পানি মিশিয়ে প্রয়োগ করে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট গাছের গোড়ায় বা মাটিতে সপ্তাহে একবার করে টানা দুই মাস ধরে প্রয়োগ করলে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। গত ৫ বছর ধরে বাঁশঝাড়ে এবং গত ২ বছর ধরে ফলজ গাছে প্রস্রাব সার প্রয়োগ করার এ সমীক্ষা চালানো হয় বলে জানান বাংলাদেশ ফিশারিজ রিচার্স ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক।
মাটির বন্ধন তৈরি
বিজ্ঞানী মোহাম্মদ আশরাফুল হক আরো জানান যে, আলগা বালি কনা বা মাটির বন্ধন তৈরিতেও ভূমিকা রাখে মানব প্রস্রাব। আলগা বালি মাটিতে এক টানা ১৫ দিন প্রস্রাব প্রয়োগের পর মাটি খুঁড়ে দেখা যায় যে, প্রস্রাবগুলো একটি বয়োমের আকারে মাটির নীচে জমা হয়ে মাটির বন্ধন তৈরি করেছে।