সাড়ে চার দশকে পদ্মায় সর্বনিম্ন পানি
পদ্মার বিশাল এলাকাজুড়ে ধু-ধু বালুচর। তার মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে পানির একটি সরু ধারা। হাঁটু পানি, তাতে স্রোত নেই। দক্ষিণে জেগে ওঠা বিশাল বালুচর থেকে গ্রামের নারীরা খড়ি ও ঘাসবোঝাই বস্তা মাথায় নিয়ে হেঁটেই পাড়ি দিচ্ছেন। এর একটু পশ্চিমে পদ্মার মাঝ পেটে শিশুরা কাদামাটি দিয়ে খেলছে নানা রকম খেলা। রাজশাহী শহর সংলগ্ন পদ্মার রামচন্দ্রপুর মৎস্যজীবীপাড়ায় গিয়ে দেখা গেল এমনই চিত্র। শুকনো মৌসুমের শুরুতে
পদ্মায় এবার পানিপ্রবাহ কমেছে ভয়াবহ রকমের। গত ৪৪ বছরের ইতিহাসে এবারই সবচেয়ে কম পানি প্রবাহিত হচ্ছে পদ্মায়। ৭ ও ৮ মার্চ পদ্মায় পানির উচ্চতা ছিল সাত দশমিক ৬৪ মিটার। ১৯৭২ সালের পর থেকে পানির উচ্চতা কখনোই এত নিচে নামেনি বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ড বোয়ালিয়া থানার রামপুর এলাকায় ১৯৭২ সাল থেকে প্রতিদিন পদ্মার পানির উচ্চতা পরিমাপ ও সংরক্ষণ করে আসছে। ওই পরিমাপে দেখা যায়, গত সাড়ে চার দশকের মধ্যে ৭ ও ৮ মার্চ ছিল পদ্মায় সর্বনিম্ন পানির উচ্চতা। এই দু’দিন টানা সাত দশমিক ৬৪ মিটার পানির উচ্চতা মাপা হয়। এর আগে ২০০৬ সালে সর্বনিম্ন পানির উচ্চতা ছিল সাত দশমিক ৭২ মিটার এবং ১৯৮৩ সালে সর্বনিম্ন পানির উচ্চতা রেকর্ড করা হয়েছিল সাত দশমিক ৭৪ মিটার।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানিবিজ্ঞান উপবিভাগীয় প্রকৌশলী এসএম আলী মর্তুজা বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পদ্মায় পানির উচ্চতা এত নিচে আর কখনোই নামেনি। এবার শুকনো মৌসুমের শুরুতেই পানির উচ্চতা নিচে নেমে যাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, আগামী মে মাস পর্যন্ত খরা চলাকালে পানির উচ্চতা আরও নিচে নামবে।’ তিনি বলেন, ‘ফারাক্কার প্রভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই পানির এই সংকট দেখা দিয়েছে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের বর্ষাকালে পদ্মায় পানির পরিমাণ ছিল ১৯ লাখ ১৪ হাজার ৬০০ কিউসেক। শুকনো মৌসুমে পদ্মায় তার অর্ধেক পানি থাকার কথা। কিন্তু ওই বছরের মার্চ মাসেই পদ্মায় পানির পরিমাণ মাপা হয় মাত্র ৪০ হাজার ৪১৫ কিউসেক। ফারাক্কা বাঁধের পর থেকেই শুকনো মৌসুমে পানির পরিমাণ এত বেশি কমে যাচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানিবিজ্ঞান উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এসএম আলী মর্তুজা।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ পানি চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমের জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার কিউসেক পানি বাংলাদেশকে দেওয়ার কথা। ফারাক্কার ভাটিতে ও পাবনার হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে তা ভারত ও বাংলাদেশ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে পরিমাপ করা হয় নিয়মিত। পাবনায় অবস্থিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় পানি পরিমাপ কেন্দ্রের সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে চুক্তি অনুযায়ী ৩৫ হাজার কিউসেক পানি নেই। চুক্তির চেয়ে কয়েক হাজার কিউসেক পানি কম প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় পানি পরিমাপ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কেএম জহুরুল হক বলেন, ‘চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বর্তমানে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পানির লেবেল কম আছে। তবে তা খুব বেশি কম নয়। ৩৫ হাজার কিউসেকের কম, তবে ৩০ হাজার কিউসেকের উপরে পানি আছে।’ তিনি বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী পানি কম পাচ্ছি এমন নয়, তবে ওরা (ভারত) দশ দিন নিচ্ছে, তারপর আমাদের দশ দিন দিচ্ছে। যখন ওরা পানি নিচ্ছে তখন পানি কমে যাচ্ছে।’
রাজশাহী শহর সংলগ্ন পদ্মার রামচন্দ্রপুর এলাকায় বেড়াতে আসা রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী শাকিলা আখতার ও তানজিমা জিনাত পদ্মার মরা রূপ দেখে হতাশ হলেন। তারা বললেন, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে যে খরস্রোতা পদ্মার বর্ণনা পড়েছি, তার সঙ্গে এই পদ্মার কোনো মিল নেই। নদীর মাঝখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। এখানে পানি নেই। আছে বালুচর। হেঁটেই মানুষ পাড়ি দিচ্ছে।’
নদী পাড়েই দেখা পাওয়া গেল গ্রামের প্রবীণ মৎস্যজীবী ফয়েজ উদ্দিন ও আবদুস সালামকে। তারা জানান, এক সময় এই পদ্মায় বড় বড় ইলিশ, রুই, বাগাড়, বোয়ালসহ শত শত প্রজাতির মাছ ছিল। এখন আর কিছুই পাওয়া যায় না। নদীর হাঁটু পানিতে মাছ শিকারে ব্যস্ত গ্রামের নবীন মৎস্যজীবী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পদ্মায় এখন আর মাছ নেই। সামান্য কিছু পুঁটি আর পিয়লি মাছ পাওয়া যাচ্ছে। বর্ষায় কিছু জাটকা ইলিশও মিলছে। তবে প্রবীণরা যেসব মাছের গল্প শোনান আমরা তা কখনোই পাইনি।’
নদী গবেষক ও হেরিটেজ রাজশাহীর প্রতিষ্ঠাতা মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘পদ্মায় পানি কমে যাওয়ার প্রধান কারণই ফারাক্কার বাঁধ। ফারাক্কার পানি পরিমাণমতো না পাওয়ার কারণেই পদ্মার এই রুগ্ণ অবস্থা।’ তিনি বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী আমরা অবশ্যই পানি কম পাচ্ছি। পানি পেলে নদীর মাঝখানে কমপক্ষে ৫ থেকে ১০ মিটার পানি থাকার কথা, আমাদের দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়।’
রাজশাহী অঞ্চলের পদ্মাকে বাঁচানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘উজানের দেশ ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে এ সমস্যাটি নিয়ে যেতে হবে। পানির নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নিতে হবে। এখন পানির নিয়ন্ত্রণটা উজানের দেশের কাছে। জাতিসংঘের আইন অনুযায়ী ভাটির দেশ-উজানের দেশ বলে কোনো কথা নেই। যেসব দেশের মধ্য দিয়ে নদী গেছে প্রত্যেকেরই নদীর পানি ব্যবহারের সমান অধিকার। ভাটির দেশের ক্ষতি হবে এমন কোনো প্রকল্প উজানের দেশ গ্রহণ করতে পারবে না। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী যে চুক্তি হয়েছে, তাতে সর্বশেষ স্বাক্ষর করেছে ভিয়েতনাম। যে স্বাক্ষর করার কথা ছিল ভাটির দেশ হিসেবে আমাদের। দুর্ভাগ্যজনক আমরা এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ গৃহীত সনদে স্বাক্ষর করিনি। ভিয়েতনাম ৩৫তম দেশ হিসেবে স্বাক্ষর করায় তা এখন আইনে পরিণত হয়েছে। এই আইনে উজানের দেশ যে কোনো প্রকল্প নেবে তাতে ভাটির দেশের জনজীবন, চাষাবাদের কোনো ক্ষতি যেন না হয় সেসব বিষয়ে আলোচনা করে নিতে হবে।’ দেশের পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বর্ষাকালে যে পানি আসছে তারও আমরা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে দেশের মধ্যে সংরক্ষণ করতে পারছি না। দেশের অভ্যন্তরের নদীগুলোকে স্লুইসগেট, বাঁধ, ক্রসড্যাম করে মেরে ফেলা হয়েছে।’