সুন্দরবনের প্রাকৃতিক রূপ রক্ষা করতে হবে

সুন্দরবনের প্রাকৃতিক রূপ রক্ষা করতে হবে

. ইনামুল হক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য ঘষিয়াখালী নৌরুটের দু’পাশে গড়ে ওঠা চিংড়িঘেরগুলো তুলে দিয়ে ড্রেজিং করার নির্দেশ দিলে আমরা বেশ আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কারণ সুন্দরবনের তেল বিপর্যয়ের পর নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছিলেন, জংলার চেয়ে মংলা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, ৯ ডিসেম্বর তেলবাহী জাহাজ ‘সাউদার্ন স্টার ৭’ অন্য একটি খালি জাহাজ ‘টোটাল’-এর ধাক্কায় ফুটো হয়ে শ্যালা নদীতে ডুবে গেলে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়ে। এ সুন্দরবন ২৬৯ প্রজাতির বিচিত্র পাখি, ডাঙার প্রাণী, মাছ ও অন্যান্য জীবের আবাসস্থল এবং ৩৩৪ প্রজাতির বিশেষ গাছপালার বন। ১৮৭৫ সালে একে ‘সংরক্ষিত বন’ ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশে এর স্থলভূমি মোট ৪ হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার এবং নদী, খাল ও খাড়ি নিয়ে জলাভূমি মোট ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭৭ সালে সমুদ্র-তীরবর্তী মোট ৩২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকায় তিনটি ‘বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করা হয়। ১৯৯২ সালে একে রামসার সাইটভুক্ত এবং ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর ডড়ত্ষফ ঐবত্রঃধমব ঝরঃবং-এর তালিকাভুক্ত করা হয়। সারা বিশ্বে এখন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এলাকাগুলোই সবচেয়ে মূল্যবান। কিন্তু দুর্বৃত্তদের দখল প্রক্রিয়ার চরম বেদনাদায়ক ও ধ্বংসাত্মক ফল সুন্দরবনের ভেতরে এ তেল দুর্ঘটনা। এর ক্ষতির পরিমাণ পরিবেশ মাপকাঠি এবং এর দীর্ঘসময়ের হিসাবে ধরলে ১ হাজার থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা হবে। নৌমন্ত্রীর আপত্তির কারণেই প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া পেতে ছয়দিন দেরি হয়ে যায়।

সারা বিশ্বের অন্যতম ঐতিহ্য সুন্দরবন ধ্বংস করার জন্য নানা মোড়কে নানা তরফ থেকে উদ্যোগ আছে। ২০০৯ সালে সুন্দরবন ও কক্সবাজারকে বিশ্বের সাতটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্র হিসেবে ভোট দেয়ার যজ্ঞ শুরু হলে সুন্দরবন ও আশপাশের এলাকা দখল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় একদল। এরই এক পর্যায়ে ২০১১ সালে বিআইডব্লিউটিএ মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথটি বন্ধ করে দেয়। এর পর খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, নড়াইল ও যশোর জেলার বিভিন্ন নদীবন্দরে যাতায়াতকারী পণ্যবাহী কার্গো জাহাজগুলো সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে শ্যালা নদীপথে যাতায়াত শুরু করে। পশুর নদের তীরে মংলা সমুদ্রবন্দর অবস্থিত বিধায় সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সমুদ্রগামী জাহাজ আসা-যাওয়া করে। এসব জাহাজ ব্যবহূত কঠিন বর্জ্য ও জ্বালানি বর্জ্য ফেলে সুন্দরবন দূষিত করতে থাকে। পরিবেশবাদীরা তাই সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য এর ভেতর দিয়ে যাতায়াতকারী জাহাজ বন্ধ এবং রামপাল এলাকায় দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। গুগল স্যাটেলাইট চিত্রে ঘষিয়াখালী নদীর দুটি রূপ পাশাপাশি পাওয়া যায়— একটি পূর্বাংশের, যা ২০১০ সালের এবং অন্যটি ২০১৩ সালের ঘষিয়াখালী নদীর পশ্চিমাংশের। এতে দেখা যায়, ২০১০ সালে এ নদীর ওপর দিয়ে কার্গোবাহী জাহাজ চলাচল করছে, আর ২০১৩ সালে নদীটি পলি পড়ে বুজে গেছে। বোঝা যায়, সুন্দরবনকে ভোট দিয়ে জয় অর্জনের পর পরই কিছু ব্যক্তি এলাকাটি দখল করার মহোত্সবে লেগে যান। বলা বাহুল্য, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও অনুগ্রহপ্রাপ্তরাই ঘষিয়াখালী ও অন্যান্য জলাভূমি দখল করে এর মালিক হয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রীর আদেশের পরই বিআইডব্লিউটিএ মংলা-ঘষিয়াখালী নৌরুটটি ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নেয়। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এ নৌরুট পুনরায় চালু করা তত সহজ ব্যাপার নয়। বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ উপজেলার পয়লাহার নদীর ঘষিয়াখালী থেকে রামপাল উপজেলার মংলা নদীর বেতবুনিয়া পর্যন্ত ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার সংযোগ খাল খনন করে ১৯৭৩ সালের নভেম্বরে মংলা-ঘষিয়াখালী নৌরুটটি চালু করা হয়। ২২ কিলোমিটার রুটটি ৪০ বছর ড্রেজিং ছাড়াই চলেছে। ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল রামপালের কাছে এমভি তিশা-১, এমভি সুমাইয়া সাজিদ ও অয়েল ট্যাংকার তুষান আড়াআড়িভাবে চরে আটকে গেলে নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তখন জরুরি ভিত্তিতে সুন্দরবনের শ্যালা নদী দিয়ে বিকল্প পথ চালু করা হয়। কিন্তু মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে একে পুনরায় চালু না করায় ২২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে যে পলি ভরাট হয়েছে, তা পুনঃখনন করতে ২০০ কোটি টাকার ড্রেজিং লাগবে বলে বিআইডব্লিউটিএ জানিয়ে দেয়। পরে সুন্দরবনকে বাঁচানোর জরুরি তাগিদে প্রায় ২৩০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে বিআইডব্লিউটিএ ১২টি নিজস্ব এবং চারটি অন্যের ড্রেজার দিয়ে কাজও শুরু করে। এ কাজে ৩০ জুন নাগাদ একমুখী চলাচলের জন্য একটি পথ খোলা সম্ভব হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি উদ্বেগ জানিয়ে এক প্রতিবেদনে বলেছে, বিআইডব্লিউটিএ ৮৩ শতাংশ কাজ করে আটটি ড্রেজার সরিয়ে নিয়ে গেছে।

প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথে রামপাল উপজেলার মংলা নদীর অংশে পলি পড়ে বেশি। এর কারণ গত ২০-৩০ বছরে এ নৌপথের দু’পাশে সংযোগ খালগুলো দখল করে চিংড়িঘের করা হয়েছে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোনা পানি প্রতিরোধ প্রকল্প নদীর ভেতরে পলিপাতনকে ত্বরান্বিত করেছে। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএর বার্ষিক বাজেটে চালু নৌরুটগুলোর সচলতা বজায় রাখতে ড্রেজিং করার ব্যবস্থা আছে। পলি বহনকারী নদীতে নৌরুট চালু রাখতে হলে অব্যাহতভাবে মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং করতে হয়। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথে ড্রেজিং কাজ বন্ধ করে সিইজিআইএসকে কনসালট্যান্ট লাগায়। এ সিইজিআইএসেরই পরস্পরবিরোধী দিকনির্দেশনায় পুরো ড্রেজিং কাজই এখন অকার্যকর হতে বসেছে। তাই কাজ শেষ না করে বিআইডব্লিউটিএর আটটি ড্রেজার সরিয়ে নেয়াটা সুন্দরবনের জন্য মোটেই ভালো খবর নয়।

জানা যায়, পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএস বলছে, মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথ সচল রাখাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বিষ্ণু, দাউদখালী ও বগুড়া নদী খুলে দিয়ে আশপাশের জমিতে জোয়ারাধার প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ধরনের প্রকল্পের কাজ হলো— জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি জোয়ারাধার এলাকায় পতিত হয়ে জমে যাবে, ফলে ওই পলি নদীতে পড়তে পারবে না। কথাটি আংশিক সত্য, কারণ জোয়ারাধার এলাকায় পলি পড়লেও নদীতে পলি পড়বে এবং সেজন্য মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং করে ওই পলি সরিয়ে নিতে হবে। আমি মনে করি, জোয়ারাধার প্রকল্প স্থায়ী সমাধান নয়, এমনকি সাময়িক সমাধানও নয়। জোয়ারাধার প্রকল্প পলিপাতনের সমস্যাকে কিছুটা হালকা করতে পারে। তাছাড়া জোয়ারাধার প্রকল্প এলাকাটি দু-এক বছরের মধ্যে পলিপাতনের ফলে ভরে গেলে ওই ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যাবে। আসলে পলিবাহিত নদীতে নৌপথ চালু রাখতে হলে মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং করে পলি সরিয়ে যেতেই হবে। তাই সিইজিআইএসের পরামর্শে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লে খারাপ হবে। জানা যায়, ড্রেজিং কমিয়ে দেয়ায় এরই মধ্যে ড্রেজিং করা খালের অনেক দৈর্ঘ্যে পলি পড়ে পুনরায় অনেকটা ভরে গেছে।

আমাদের কথা, সুন্দরবন রক্ষা করতেই হবে। তাই সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচলকারী নৌযানের রুট বন্ধ করতে হবে। কেবল মংলা বন্দরে যাতায়াতকারী জাহাজগুলোর জন্য সাগর থেকে পশুর নৌপথটি খোলা রাখা যাবে। ভারত থেকে আসা-যাওয়ার জাহাজগুলো রাইমঙ্গল, কালিন্দী নদীপথ হয়ে সুন্দরবনের উত্তর দিয়ে মংলা পৌঁছবে এবং সেখান থেকে মংলা-ঘষিয়াখালী পথ ধরে মেঘনার পথে পাড়ি দেবে। এজন্য মংলা-ঘষিয়াখালী রুটটি সারা বছর চালু থাকা জরুরি। সরকার যেহেতু ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সে অনুযায়ী অবিলম্বে সবক’টি ড্রেজার ফিরিয়ে এনে কাজে লাগিয়ে ১০০ শতাংশ ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের খননকাজ শেষ করতে হবে। এবং ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ হলে পরেই ড্রেজারগুলোর সংখ্যা কমিয়ে মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং চালিয়ে যেতে হবে। সুন্দরবন রক্ষা করতে হলে কেবল মংলা-ঘষিয়াখালী রুটটি চালু করাই নয়, কয়লানির্ভর বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের প্রকল্পগুলো বাতিল এবং এ এলাকায় শিল্পবর্জ্যসহ সব ধরনের বর্জ্য নিক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মংলা-ঘষিয়াখালী রুটে পলি পড়ার সমস্যা কমানোর জন্য বিষ্ণু, দাউদখালী ও বগুড়া নদীসহ আশপাশের ৩১টি খাল খুলে দিয়ে পুনরায় চালু করতে পারলে ভালো, কিন্তু এ অজুহাতে ড্রেজিং কমানো বা বন্ধ করা যাবে না।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫-২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডা গ্রহণ’ শীর্ষ বৈঠকে যোগ দেন। ওই বৈঠকে তিনি পরিবেশ রক্ষা বিষয়ক ‘চ্যাম্পিয়নস অব দি আর্থ’ পুরস্কার গ্রহণ করেন। এ পুরস্কার ২০০৮ সালে বাংলাদেশের এক বিশিষ্ট পরিবেশকর্মী ড. আতিকুর রহমান পেয়েছিলেন। এবার এ পুরস্কার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দেয়ার পেছনে পরিবেশের ওপর তার কাজ ও লক্ষ্যকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আমরা সুন্দরবন রক্ষার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তিনিই সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য মংলা-ঘষিয়াখালী রুটটি চালু করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং তারই নির্দেশে কাজ চলছে। এখন জোয়ারের পানির সময় কিছু জাহাজ চলাচলও করতে পারছে। আমরা আশা করি যে, রুটটি সম্পূর্ণভাবে চালু করার পথে কোনো বাধাই কার্যকর থাকবে না।  বণিক বার্তা

লেখক: প্রকৌশলী; সাবেক মহাপরিচালক

বাংলাদেশ পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা

আহ্বায়ক, আম জনতার দল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.