সেই চকবাজারের ইফতারি

সেই চকবাজারের ইফতারি, সেই চির-পরিচিত হাঁক-ডাক। রাস্তার মাঝখানে সারি সারি দোকান। ঠাসা ভিড়। সেই ভিড়ের ভিতর থেকে বিক্রেতার কণ্ঠস্বর কানে ভাসে ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙ্গায় ভইরা লইয়া যায়’…। এ চিত্র চকের ইফতারবাজারের।

বাহারি ইফতারির ঐতিহ্য ধরে রেখেছে রাজধানীর পুরানো ঢাকার চকবাজার। ইফতার নিয়ে আলোচনা এলেই সবার আগে চলে আসে চকবাজারের কথা। এখানকার ইফতারিতে কি আছে যার টানে ভোজনরসিক বাঙালি বার বার ছুটে যায় সেখানে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শত বছরের ঐতিহ্যের ছোঁয়া আছে চকবাজারের ইফতারিতে। একসময় চকবাজারের শাহী মসজিদের সামনে একটি কূপ ছিল। তার চারপাশেই চেয়ার-টেবিল বিছিয়ে বিক্রি করা হতো ইফতারির বিভিন্ন পদ। কালের বিবর্তনে চকবাজারের ইফতারি-বাজার ক্রমেই জমে উঠেছে। এখানে যারা ইফতারি তৈরি করেন তাদের অনেকেই বংশপরম্পরায় এ কাজ করেন। এদের অনেকেই যারা সারাবছর অন্য কাজ করলেও রমজানের সময় চকে ইফতারি বিক্রি করেন।

ঐতিহাসিকদের মতে, মোগল আমল থেকেই চক বাজারে বাহারি ইফতারির প্রচলন ঘটে। তবে এখন চকের পাশাপাশি পুরানো ঢাকার বাংলাবাজার, সদরঘাট, নবাবপুর, বংশাল, সিদ্দিকবাজার, গুলিস্তান, ওয়ারী, লক্ষ্মীবাজার, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, আরমানিটোলা, সুরিটোলা, কাপ্তানবাজার, চানখাঁর পুল, আজিমপুর, টিপু সুলতান রোড, ধোলাইখালসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় বাহারি ইফতারি পাওয়া যায়। গতকাল মঙ্গলবার রমজানের প্রথমদিন চকবাজারে গিয়ে দেখা যায়, ইফতারি কিনতে ক্রেতাদের ভিড়। ভিড়ে কথাই শোনা যায় না। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দুপুর বারোটা থেকেই শাহী মসজিদের সামনের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। শুধু পুরানো ঢাকার বাসিন্দাই নন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রেতারা ছুটে এসেছেন এখানে ইফতারি কিনতে।

 

কি নেই চকের ইফতারি মেন্যুতে

বিশাল শিকের সঙ্গে জড়ানো সুতি কাবাব আর জালি কাবাব, টিক্কা কাবাব অন্যতম।

এছাড়া মোরগ পোলাও, লাবাং, পরোটা, ছোলা, বিভিন্ন ধরনের কাটলেট, শাহী জিলাপি, পেঁয়াজুসহ নানা পদের খাবার উল্লেখ করার মতো। রয়েছে শাকপুলি, ডিম চপ, কাচ্চি বিরিয়ানি, তেহারি, কবুতর ও কোয়েলের রোস্ট, খাসির রানের রোস্ট, দইবড়া, হালিম, নূরানি লাচ্ছি, পনির, পেস্তা বাদামের শরবত, ছানামাঠা, কিমা পরোটা, ছোলা, ঘুগনি, বেগুনি, আলুর চপ ইত্যাদি। চকের ইফতার বাজারের একটি জনপ্রিয় পদ ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। কারিগর সেন্টু মিয়া জানান, এটা পুরানো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পদ। প্রায় ৩৫ বছর ধরে এটা বিক্রি করছেন বলে তিনি জানান। সেন্টু মিয়া বলেন, এটি তৈরিতে ডিম, গরুর মগজ, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনা মরিচ, গরুর কলিজা, মুরগির মাংসের কুচি, মুরগির গিলা-কলিজা, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, চিড়া, ডাবলি, বুট, মিষ্টি কুমড়াসহ ১৫ রকমের উপকরণ ও ২৪ ধরনের মসলা প্রয়াজন। একটি পিতলের বড় থালার সবকিছু দুই হাতে ভালোভাবে মাখিয়ে তারপর ঠোঙ্গায় করে বিক্রি করা হয়।

তিনি বলেন, পুরানো ঢাকার এমন অনেক পরিবার আছে যাদের এটি ছাড়া ইফতার পূর্ণতা পায় না। নতুন ঢাকার বাসিন্দারাও দিন দিন এ খাবারটির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এ বছর নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এ খাবারের দামও বেড়েছে বলে জানান তিনি। এ বছর প্রতি কেজির দাম রাখা হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা।

অন্যান্য পদের মধ্যে খাসির কাবাব প্রতি কেজি ৮০০, গরুর কাবাবের কেজি ৬০০ টাকা। খাসির রানের রোস্ট প্রতি পিস ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা , দেশি ছোট মুরগি রোস্ট ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, কবুতরের রোস্ট ১৩০ টাকা পিস। এছাড়া চিকন জিলাপি কেজি ১২০ টাকা, বড় শাহী জিলাপি ২০০ টাকা। দইবড়া কেজি ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, চিকেন স্টিক পিস ৭০ থেকে ৯০ টাকা, জালি কাবাব ২০ থেকে ৪৫ টাকা, বিফ স্টিক ৪০ থেকে ৬০ টাকা, কিমা পরোটা ৩০ থেকে ৫০ টাকা, টানা পরোটা ২০ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে।

ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে ছেলে রূপমকে সাথে নিয়ে চকবাজারে ইফতারি কিনতে এসেছিলেন কামরুল হাসান। তিনি জানান, প্রতি বছরই তিনি প্রথম রমজানে ইফতারি কিনতে এখানে আসেন। একটা অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। পুরানো ঢাকার বাসিন্দা হাজী মো: বদরুল বলেন, চকের ইফতারিতে রয়েছে ঐতিহ্যের ছোঁয়া। পরিবারের সদস্যরাও চান এখানকার ইফতারি দিয়ে ইফতার সারতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.