স্কুল বেতনে হঠাৎ ‘নৈরাজ্য’, অভিভাবকরা রাস্তায়
নতুন বেতন কাঠামোতে সরকারি চাকুরেদের বেতন বাড়ার যুক্তি দেখিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেসরকারি স্কুল ও কলেজে শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়ানো হয়েছে ব্যাপক হারে, যার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন অভিভাবকরা। গত দুই সপ্তাহে তারা বিভিন্ন স্কুলের সামনে মানববন্ধন, শিক্ষামন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়া ও অবস্থান ধর্মঘটের মতো কর্মসূচি পালন করেছেন; সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ না দেখে প্রকাশ করেছেন ক্ষোভ। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক ফাহিমা খাতুন বলছেন, সরকারি নির্দেশনার বাইরে গিয়ে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির সুযোগ নেই; তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এবিষয়ে করণীয় জানতে চেয়ে মাউশির পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলেও গণমাধ্যমের খবর। রাজধানীর স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সংগঠন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি একলাফে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বিয়াম স্কুল, আইডিয়াল স্কুল, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল, শহীদ লেফটেন্যান্ট আনোয়ার গার্লস স্কুল, বাংলাদেশ ব্যাংক আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি স্কুলে ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ ফি বাড়ানো হয়েছে। মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেন্ট জোসেফ উচ্চ বিদ্যালয়, ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল, সিদ্বেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, জুনিয়র ল্যাবরেটরি স্কুলসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ফি বাড়ানো হয়েছে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। “স্কুলগুলো পে-স্কেলের অজুহাতে লুটপাটের দোকান খুলেছে। প্রায় প্রত্যেকটি স্কুলে দ্বিগুণ ফি আদায় করা হচ্ছে,” বলেন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের এই নেতা। হারুনুর রশিদ নামে কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্কুলের বাংলা মাধ্যমে বিভিন্ন ধাপে একহাজার ৩০০ টাকা থেকে দুই হাজার ১০০ টাকা, ৬০০ থেকে একহাজার ১০০ টাকা এবং ইংরেজি মাধ্যমে একহাজার ৯০০ থেকে দুই হাজার ৭৫০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর প্রতিবাদে রোববার থেকে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে লাগাতার অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছেন অভিভাবকরা। তারা বলছেন, সরকারি চাকুরেদের বেতন বাড়ার কথা বলে স্কুলের বেতন এভাবে বাড়ানোয় হঠাৎ তাদের ওপর বড় ধরনের আর্থিক চাপ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়াতে হলে টিউশন ফি বাড়ানোর ছাড়া কোনো উপায় নেই তাদের। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের আন্দোলনরত অভিভাবক ফোরামের মুখপাত্র শামিমা সুলতানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধির অজুহাতে স্কুল কর্তৃপক্ষ টিউশন ফি প্রায় দ্বিগুণ করেছে। আমরাও আন্দোলনে আছি। কিন্তু সদুত্তর তো পাচ্ছি না।” বর্ধিত টিউশন ফি প্রত্যাহারের দাবিতে গত বুধবার শিক্ষামন্ত্রী এবং মাউশি’র মহাপরিচালক বরাবর স্মারকলিপি দেওয়ার কথা জানান তিনি। “দাবি আদায় না হলে আমরা রোববার থেকে স্কুলপ্রাঙ্গণে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করব।” মাউশি’র মহাপরিচালক ফাহিমা খাতুন বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান, অতিরিক্ত টিউশন ফি আদায়ের বিষয়ে উইলস লিটল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষকে তারা কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছেন। তবে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ আবুল হোসেন দাবি করেছেন, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তেমন কিছু তারা পাননি। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আজ তো শুক্রবার। শোকজ করা হলে আমরা তার জবাব দেব।” বেতন বাড়ানোর যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, “প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আয় দিয়ে ৩৯৮ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন দিতে হয়। পে-স্কেলে অন্যদের বেতন বেড়েছে। এখন আমাদের এখানেও বেতন বাড়াতে হবে। এ কারণে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বাড়ানো হয়েছে। “সেটা না বাড়ালে এদের বেতন-ভাতা কীভাবে দেব? অন্যদিকে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তো পে-স্কেল দেওয়ার দাবিতে কর্মবিরতিতে যাওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছেন।” অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেতন ‘একটু বেশিই’ বেড়েছে বলে স্বীকার করে অধ্যক্ষ আবুল হোসেন। “কয়েকটি ধাপে গড়ে ৪৯ শতাংশ বেতন বেড়েছে। বাড়ানোর এই হার ভিকারুননিসা, আইডিয়াল স্কুলের কাছাকাছি।” ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবকরাও বর্ধিত ফি প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছেন; বৃহস্পতিবার মূল ক্যাম্পাসের সামনে বিক্ষোভ করেছেন তারা। তাদের অভিযোগ, এই স্কুলে প্রথম শ্রেণির বেতন ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছে, যা ইতোমধ্যে কার্যকরও হয়েছে। দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত ৮০০ টাকার বেতন বাড়িয়ে এক হাজার ৬০০ টাকা, সপ্তম থেকে দশম শ্রেণিতে ৯০০ টাকা থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা করা হয়েছে। এ বিষয়ে ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার স্কুলে ৭০ শতাংশের বেশি নন-এমপিভুক্ত শিক্ষক। তাদের বেতন-ভাতা এমপিভুক্ত শিক্ষকদের মতো দিতে হয়। সেটার পুরোটাই আসে স্কুলের নিজস্ব আয় থেকে। “স্কুলের নিজস্ব আয় মানে শিক্ষার্থীদের বেতন, উন্নয়ন ফি। ভর্তির ফি বাড়ানো ছাড়া শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো সম্ভব না। আমরা বাধ্য হয়েই বাড়াচ্ছি।” অভিভাবকরা এর মধ্যে বর্ধিত বেতন কার্যকর করার অভিযোগ তুললেও অধ্যক্ষ বলেন, সব শ্রেণিতে কী পরিমাণে বাড়বে তা এখনো ঠিক হয়নি। মেহেদী হাসান নামে এক অভিভাবক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ স্কুলে প্রায় ৭০০ শিক্ষকের মধ্যে ১৪৫ জন এমপিওভুক্ত। বাকি শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ করলেও প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২৪ হাজার শিক্ষার্থীর বেতন সর্বোচ্চ ২০০ টাকা করে বাড়ালেই হয়। “শুধু বেতন দ্বিগুণ করলে প্রতিষ্ঠানটি অতিরিক্ত আয় হবে ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকা। শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ করলেও এতো টাকার প্রয়োজন হবে না।” মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক এলিয়াছ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফি বাড়ানোরে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা আছে, যা গত বছর থেকে চালু আছে। সেই নীতিমালার বাইরে গিয়ে যারা ফি বাড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।” গত বছরের ২৯ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা ভর্তি নীতিমালার ১০ (ক)-তে বলা হয়েছে, “ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় অবস্থিত আংশিক এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন এবং এমপিওবহির্ভূত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য শিক্ষার্থী ভর্তির সময় মাসিক বেতন, সেশন চার্জ ও উন্নয়ন ফিসহ বাংলা মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা এবং ইংরেজি ভার্সনে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা গ্রহণ করতে পারবে।” “উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের কাছে এসছে, আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি, মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে,” বলেন এলিয়াছ। অন্য যেসব স্কুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, সেসব বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান এই কর্মকর্তা। এদিকে চট্টগ্রামেও সিটি করপোরেশন পরিচালিত ৪৬টি স্কুলে এবং ইপিজেডে নৌবাহিনী স্কুল অ্যান্ড কলেজের বেতন বাড়ানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভে রয়েছেন অভিভাবকরা। কয়েকদিন আগে কর্মসূচি চলার সময় তাদের উপর পুলিশের লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটে।