হাজারি গুড়ের দেশে

সারা দেশে খেজুরের গুড় পাওয়া গেলেও হাজারি গুড়ের জন্য বিখ্যাত মানিকগঞ্জের ঝিটকা গ্রাম। এখানকার উৎপাদিত হাজারি গুড়ের চাহিদা দেশব্যাপী। মধ্যপাচ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকায় এই গুড়ের সুনাম রয়েছে। লিখেছেন শওকত আলী রতন
দেশের একমাত্র হাজারি গুড়ের উৎপাদনকারী জেলা মানিকগঞ্জ। মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার বালতা ইউনিয়নের ঝিটকা গ্রামে প্রায় দেড় শ’ বছর আগে হাজারি গুড়ের উৎপাদন শুরু করেছিলেন স্থানীয় গাছি মিনহাজউদ্দিন আবেদিন হাজারি। সেই থেকে আজো অতীত ঐতিহ্যকে ধরে রেখে খেজুরের রস দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি এই হাজারি গুড় বাজারজাত করে যাচ্ছেন এখানকার গাছিরা। হাজারি গুড়ের জন্য মানিকগঞ্জ জেলা দিন দিন সমৃদ্ধ হয়েছে।
সারা দেশে খেজুরের গুড় পাওয়া গেলেও হাজারি গুড়ের জন্য বিখ্যাত মানিকগঞ্জের ঝিটকা গ্রাম। এখানকার উৎপাদিত হাজারি গুড়ের চাহিদা দেশব্যাপী। মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকায় এই গুড়ের সুনাম রয়েছে।
শীত মওসুমে ঝিটকা গ্রামের খেজুরগাছকে কেন্দ্র করে একটি শিল্প পরিণত হয়। রস থেকে গুড় উৎপাদনে গাছিসহ অনেক পেশার মানুষ এর
সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে থাকেন।
কিন্তু কিভাবে এলো এই হাজারি গুড়? কিংবা এই গুড় তৈরির পদ্ধতি কিভাবে পেল এখানকার লোকেরা? হ্যাঁ, একটি মজার গল্প আছে এ
নিয়ে- ঝিটকা গ্রামের হাজারি পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে জানা যায়, প্রায় দেড় শ’ বছর আগে হাজারি প্রামাণিক নামে এক ব্যক্তি স্বপ্ন দেখেছিলেন বিশেষ পদ্ধতিতে খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ ও তা গুড় তৈরির পদ্ধতি। এর পর থেকেই হাজারি প্রামাণিক এই বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করে রস থেকে গুড় তৈরি করতে থাকেন। প্রচলিত এই গল্প নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও বলা হয়ে থাকে এই গুড় তৈরির পদ্ধতি একটু ব্যতিক্রমধর্মী। আর সুস্বাদু এই গুড়ের নামকরণ হাজারি প্রামাণিকের নামেই করা হয়। সেই থেকে এই গুড়ের নাম হাজারি গুড়।
দেশের আর কোথায় এই হাজারি গুড় তৈরি করা হয় না বলে জানা যায়। তাই আসল হাজারি গুড় সংগ্রহ করতে হলে অবশ্যই মানিকগঞ্জ জেলার ঝিটকা গ্রামে যেতে হবে।
বর্তমানে ঝিটকা গ্রামের হাজারি পরিবারের ১৫-২০ জন গাছি খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরির সাথে সম্পৃক্ত।
এই পরিবারের দেখাদেখি ঝিটকা গ্রামের অন্য গাছিরাও হাজারি গুড় উৎপাদন করে থাকেন।
তবে প্রকৃত হাজারি গুড় তৈরি মূলমন্ত্র একমাত্র তার পরিবারের সদস্যরাই জানেন বলে জানা যায়।
সব মিলিয়ে ৩০ থেকে ৩৫টি পরিবার এ পেশার সাথে জড়িত।
বছরের অন্য সময় ঝিটকা গ্রামের মানুষজন অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকলেও শীত মওসুমে সবাই গুড় তৈরি কাজে ব্যস্ত থাকে। রস সংগ্রহ, জ্বাল দেয়া ও গুড় বানানো এ কাজে পরিবারের সবাই সহযোগিতা করে থাকে বলে জানা যায়।
অন্য যেকোনো খেজুরের গুড়ের তুলনায় হাজারি গুড়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- হাতে নিয়ে ঘষা দিলেই সাথে সাথে তা ফাঁকি হয়ে যায় তার প্রমাণ করলেন একজন বিক্রেতা।
দাদার আমল থেকে গুড় উৎপাদন ও বাজারজাত করার কাজের সাথে জড়িত রইচ উদ্দিন হাজারি জানান, গাছ থেকে রস সংগ্রহ থেকে শুরু করে জ্বাল দেয়া ও গুড় বানানো পর্যন্ত বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
মিনহাজউদ্দিন আবেদিন হাজারি যেভাবে গুড়
তৈরি করেছেন ঠিক একই পদ্ধতিতে আমরা গুড় উৎপাদন করে আসছি। হাজারি গুড় উৎপাদনে সময়, শ্রম ও অর্থ বেশি লাগলেও এ গুড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে আমাদের দেশে।
প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসেন এই ঝিটকার হাজারি পাড়ায়।
আব্দুল বাছের হাজারি জানান দেশের কোথায় হাজারি গুড় বানানো হয় না। ঝিটকা গ্রামে হাজারি গুড় উৎপাদন করার কারণে দেশের মানুষের কাছে মানিকগঞ্জ জেলার আলাদা পরিচিতি রয়েছে। সেইসাথে এই গুড়ের ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে।
তিনি জানান, ঝিটকার হাজারি গুড়ের হাট বসে প্রতি শনিবার।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গুড় কেনার জন্য এই হাটে আসে মানুষজন। দিন দিন খেজুরের রস
কমে যাওয়ায় গুড়ের উৎপাদন কম হচ্ছে। প্রতি কেজি হাজারি গুড় ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকে। ঝিটকা গ্রামের গাছি হযরত আলী জানান, ঝিটকার হাটে হাজারি গুড়ের মতো দেখতে একই রকমের গুড় কম দামে পাওয়া গেলেও স্বাদে-গন্ধে পার্থক্য অনেক।
ঝিটকার হাটে কিছু অসাধু গুড় ব্যবসায়ী কৃত্রিম উপায়ে গুড় তৈরি করে এবং হাজারি গুড়ের সিল ব্যবহার করে দীর্ঘ দিন ধরে ক্রেতাদের বিভিন্নভাবে প্রতারিত করে আসছে।
স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় তাই দাম বেশি হলেও হাজারি গুড় কিনতে কেউ কার্পণ্য করেন না।
নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে মানিকগঞ্জের স্বনামধন্য ঐতিহ্যবাহী হাজারি গুড় তৈরি করে যাচ্ছেন স্থানীয় গাছিরা। তার পরও
সরকারিভাবে এ শিল্পটিকে টেকসই করার উদ্যোগ নেয়া হলে আগামীতে ব্যাপক ভিত্তিতে বাজারজাত করা যেতে পারে মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী এ হাজারি গুড়।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.