হারিয়ে যাচ্ছে শিশুদের সিনেমা ও গান!

শিশুদের জন্য লেখার কলম যেন থেমে আছে, গানের সুরে নীরবতা বাজে, শিশুদের চলচ্চিত্রের পর্দায়ও কি পড়েছে সিলগালা? বাংলাদেশে শিশুদের সিনেমার বর্তমান অবস্থার কথা জানাতে গিয়ে এমন মন্তব্য করেন অনেকে। ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’ সেই গানটা আজও বাজিয়ে চলেন তখন যারা শিশু ছিলেন তারা। এখনকার শিশুদের জন্য এমন একটা গানও তো নেই- এভাবে আক্ষেপ প্রকাশ করেন অভিভাবকরা। কেন ও কীভাবে হলো এমনটা- এই প্রশ্নের জবাবে নির্মাতা,গায়ক,সংগীত পরিচালক ও চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা দিলেন ‘বাস্তবতার’ দোহাই!
প্রযোজক সমিতির তথ্য মতে,২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা ৭৮। আর ২০১৩ সালে এই সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছে ৫০ এর কোঠায়। শিশুদের জন্য খুঁজে পাওয়া যাবে না একটি ছবি কিংবা একটি গানও।
একসময় শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে ৫০টির বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন। এছাড়া পরবর্তীতেও শিশু অভিনয়শিল্পীর জন্য আরও কিছু গানে গলা মিলিয়েছেন তিনি। অতীত-বর্তমান মিলিয়ে নিজের অনুভূতির কথা জানালেন এ শিল্পী।
তিনি বলেন, ছোটবেলায় বহু ছবিতে আমি গান করেছি। পরবর্তীতেও কিন্তু গেয়েছি। আসলে তখন ছবিতে এ ধরনের গল্প থাকত। যার ফলে গান গাওয়ার সুযোগ তৈরি হতো। কিন্তু এখন কি এমন ছবি তৈরি হচ্ছে? একটা ছবিতে শিশুদের গান থাকতেই হবে, এমন তো কথা নেই। কিন্তু চলচ্চিত্র বেশ বড় মাধ্যম। শিশুর বিকাশে যা আমরা কাজে লাগতে পারি।
সাবিনা ইয়াসমিন আরও বলেন, পাশ্চাত্যের অনেক দেশে মিউজিক্যাল ছবি তৈরি হচ্ছে, বিশেষ করে ত্রিমাত্রিক ছবি। আমাদের দেশে তো এটা ভাবাই যায় না। আর এগুলো কিন্তু শিশুরা বেশ পছন্দ করে। তাই এগুলো নিয়ে ভাবা উচিত। কারণ আমাদের এখানে বাচ্চাদের বিনোদনের মাধ্যম সীমিত। তাদের জন্য সিনেমা ও নির্মাণ খুব জরুরি।
৮০‘র দশকের জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক শেখ সাদী খান। সবধরনের গানের মধ্যে তিনি শিশু কণ্ঠের গানও সুর করেছেন। তার ভাষ্য, ‘বাংলা চলচ্চিত্রে শিশু শিল্পীর জন্য গান তৈরি না হওয়ার অন্যতম কারণ এখন শিশুতোষ ছবিই নির্মাণ হচ্ছে না। আর ছবি নির্মাণ না হওয়ার জন্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থাও দায়ী বলে মনে হয় ‘
তিনি বলেন, শিশুদের তৈরি হচ্ছে না আলাদা কোনও গল্প। শুধু ভাবা হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সস্তা বিনোদনের কথা। যার ফলে কাহিনীকারও গল্প সাজাচ্ছেন সেভাবে। যেখানে শিশু চরিত্র কমে যায়। তাই একজন সংগীত পরিচালকের গান তৈরির কোনও সুযোগও থাকে না। আবার হয়তো ব্যবসার দিকও বিবেচনা করা হতে পারে। কারণ এখন আইটেম গানের চলটা বেশ চলছে। একটা আইটেম গান করলেই আলাদাভাবে কাভারেজ পাওয়া যায়। গান হিট হলেই ভাবা হয় চলচ্চিত্র হিট। তাই বাণিজ্যিক ছবি নির্মাতাদের মাথায় এখন শিশুতোষ গানের চেয়ে আইটেম গানের চিন্তাটা ঢুকে গেছে।
‘কলমীলতা’ বা ‘হত্যা’ ছবির জন্য শিশুদের গানের সুর করা সাদী আরও বলেন, ‘নতুনদের এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ এখন ছবি মুক্তি পায় কিন্তু শিশুতোষ ছবি বা শিশুশিল্পীর গান তৈরি হয় না।’
কণ্ঠশিল্পী শাম্মী আকতারের গাওয়া ‘সত্য-মিথ্যা’ ছবির ‘বাবা আমার বাবা’ বা ‘ভাই-ভাই’ ছবির ‘ভাই আমার ভাই তুমি’ গানগুলো এখনও হঠাৎ ভেসে আসে কান। যা শুনে অনেকের চোখ সিক্ত হয়। এ শিল্পী জানান, আসলে একজন কণ্ঠশিল্পী চলচ্চিত্রের একটি অংশ যারা গাওয়া ছাড়া নির্মাণে আর কোনও প্রভাব ফেলতে পারেন না। আমিও একই কাতারের। আর এখন তো গানের জন্য প্রস্তাব সেভাবে আসেই না। তাই চলচ্চিত্রে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। নতুনরা গান করছে। তারা ভালো করছে। তবে তাদেরও কিছু করার নেই। এটা নতুন চলচ্চিত্র নির্মাতারা করতে পারবেন। যদি তারা চান।
তবে গান শিশুকে সৃষ্টিশীল হয়ে উঠতে সয়াহতা করে বলে জানালেন সংগীত পরিচালক ইমন সাহা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এ শিল্পী স্মৃতিচারণ করে বললেন, আমি কিন্তু ছোটবেলায় সিনোমা হলে যেতাম। তখন থেকে আমার মনে হতো আমি যদি ‘অমুকের’ মতো হতে পারি। এ আক্ষেক তখনই হবে যখন একজন শিশুর হলে যাওয়ার মতো আগ্রহ থাকে।
তিনি বলেন, যখন দেখবে তার মতো একজন গান গাইছে,সে কিন্তু তখন গায়ক বা অভিনেতা হতে চাইবে। তাদের কল্পনার জগত খুলে যাবে। এমনটা তো আমারই হয়েছে। ছোটবেলায় আমি ভাবতাম বড় পুরস্কার মানে বিরাট মাপের পুরস্কার। একদিন বড় দা পুরস্কার নিয়ে বাসায় এলেন। আর আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম আমিও সংগীত পরিচালক হব। ঘোষণা দিলাম, বড়দার চেয়েও বড় পুরস্কার আমি ঘরে আনব। যার সাইজ হবে আলমারির মতো! শিশুরা কিন্তু এখন এই অনুপ্রেরণার জায়গা পাচ্ছে না। এটা নিয়ে ভাবা উচিত। আর শুধু শিশুতোষ ছবি কেন, এমনিতেই সাধারণ ছবিতে গান নিয়ে কাজ করার সুযোগ থাকে। শুধু ছবির পরিচালককে সে ধরণের গল্প বাছাই করতে হবে।
ছোটবেলার ঘটনা পরবর্তী জীবনে কতটা প্রভাব ফেলে তা জানাতে মনোচিকিৎসক সালাউদ্দিন কাওসার বিপ্লব বলেন, একটা চলচ্চিত্রর মতোই একটা গানও শিশুদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। শিশুদের জন্য নির্মিত চলচ্চিত্র বা গান তাদের কল্পনার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। তাই গান বা সিনেমার বিষয়বস্তু নির্বাচন এ ক্ষেত্রে বেশ জরুরি।
‘আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, বাংলাদেশ’-এর প্রবন্ধ ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র আর্কাইভের তথ্য মতে, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সর্বাঙ্গীন শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে পাওয়া যায় ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ (১৯৮০)। বাদল রহমান পরিচালিত এই চলচ্চিত্র সরকারি অনুদানে নির্মিত হয়েছিল। অনুদানপ্রাপ্ত আরেকটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র মোরশেদুল ইসলামের ‘দীপু নাম্বার টু’ (১৯৯৬)। একই পরিচালকের ‘দূরত্ব’ (২০০৪) ছবিটি নির্মিত হয়েছে বেসরকারি পর্যায়ে, ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রযোজনায়।
তবে পূর্ণাঙ্গ শিশুতোষ না হলেও একসময় বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রে শিশুচরিত্রের বেশ প্রাধান্য ছিল। এমন কিছু চলচ্চিত্র সুভাষ দত্তের ‘ডুমুরের ফুল’ (১৯৭৮), আজিজুর রহমানের ‘অশিক্ষিত’ (১৯৭৮) ও ‘ছুটির ঘণ্টা’ (১৯৮০), শেখ নজরুল ইসলামের ‘এতিম’ (১৯৮০) ও ‘মাসুম’ (১৯৮১), শহীদুল আমিনের ‘রামের সুমতি’ (১৯৮৫) ইত্যাদি ছবির প্রধান চরিত্র বা অন্যতম প্রধান চরিত্র ছিল শিশু-কিশোররা।
নব্বই দশক থেকে পারিবারিক-সামাজিক ধারা কমে গিয়ে সহিংস-অপরিশীলিত রুচির সিনেমার সংখ্যা বেড়ে যায়। এসময় শিশুচরিত্র ছিল না বললেই চলে। থাকলেও তার উপস্থিতি স্বল্প সময়ের জন্য এবং তাও সহিংসতার কারণ বা অনুষঙ্গ হিসেবেই হাজির হয়ে এসেছে। তবে মূল সিনে-সংস্কৃতির বাইরে, অনেকটা প্রচারহীনভাবে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০টি ছবি প্রযোজনা করেছে।
এ বিষয়ে নির্মাতারা কী ভাবছেন তা জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, শিশুতোষ ছবি থাকলেই যে গান নির্মাণ হবে তাও কিন্তু নয়। আমাদের আসলে কিছু দৃশ্য হারিয়ে যাচ্ছে। হয়ত সিনেমায় শোয়া, রান্না বা খাবার টেবিলের কোনও দৃশ্য থাকছে না। এগুলো তো পারিবারিক আবহ ফুটিয়ে তোলে। এসব দৃশ্যেই গান তৈরি হয়।
তবে কি নির্মাতারা শহুরে গল্প বাছাই করছেন? এমন প্রশ্নে তিনি বললেন, এটা ঠিক শহুরে গল্পই নির্মাতাদের প্রভাবিত করছে। গল্প বাছাইটা প্রধান বিষয় মনে হয়। আর আইটেম প্রভাব ফেলছে বলে মনে হয় না। কারণ আমাদের এমন অনেক শিশুতোষ গান আছে যা ছবির প্রচারে বেশ কাজে লেগেছে। বাণিজ্যিক দিক থেকে আইটেম গানের চেয়ে এ গানগুলোই সফল। আমাদের ভাবতে হবে ছবি নির্মাণ নিয়ে।
এ নির্মাতা জানালেন, সরকারি অনুদানের ক্ষেত্রেও পাঁচটির মধ্যে দুটি শিশুতোষ সিনেমা নির্বাচন করা হয়। তবে এখানে শর্ত হলো ভালো গল্প থাকতে হবে। কিন্তু শিশুদের গানের জন্য মূল সহায়ক নির্মাতাদের পরিকল্পনা ও সচেতনতা।
তিনি আরও জানান, আশির দশকে মাস্টার সুমন কিংবা মাস্টার শাকিল তারকাখ্যাতি পেয়েছিলেন। কারণ, তারকা হয়ে ওঠার মতো যথেষ্ট পরিসর জুড়ে শিশু-কিশোর চরিত্রের উপস্থিতি থাকত, ছিল তাদের মানানসই গান। যা হয়ত শিশুদের চিত্ত বিকাশেও সহায়তা করত। আর এখন তো ছবির শিশু চরিত্র বা গানও চলে গেছে কাটছাঁটের তালিকায়। বাংলাট্রিবিউন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.