হুমায়ূন আহমেদ
পাখি উড়ে গেলেও পলক
ফেলে যায় আর মানুষ
চলে গেলে ফেলে রেখে যায়
স্মৃতি ।
——— হুমায়ূন আহমেদ
বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম হুমায়ুন আহমেদ। তার বইয়ের ভাষায় কথার জাদুতে মোহিত হননি এমন বাঙালি পাঠক পাওয়া যাবে না বললেই চলে। তিনি যতটানা লিখেছেন, তারচেয়ে বেশী পাঠক সৃষ্টি করেছেন, সাবলিল ভাষায় লেখা তার গল্প উপন্যাস সব শ্রেনীর মানুষকেই মুগ্ধ করেছে। তার নির্মিত চরিত্র হিমু, মিসির আলীরাও পাঠকের কাছে তারকা হয়ে গেছে। এই কথার জাদুকর হুমায়ূন আহমেদের ৭০তম জন্মদিন। ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদকে হারানোর শোক আজও লালন করছেন লাখো পাঠকের হৃদয়। তবুও আনন্দ আয়োজনে ভক্ত-পাঠকরা কাল (রোববার) পালন করবেন তার জন্মদিন।
হুমায়ূন আহমেদ
জন্ম | ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ কুতুবপুর গ্রাম, কেন্দুয়া, নেত্রকোনা জেলা, পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) |
---|---|
মৃত্যু | ১৯ জুলাই ২০১২ (৬৩ বছর) নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র |
সমাধিস্থল | নুহাশ পল্লী |
জীবিকা |
|
জাতীয়তা | ![]() |
জাতি | বাঙালি |
শিক্ষা | |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় |
সময়কাল | ১৯৭২–২০১২ |
ধরন |
|
বিষয় | রসায়ন , সমসাময়িক জীবন |
উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহ | জোছনা ও জননীর গল্প, নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, দেয়াল, মধ্যাহ্ন |
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | বাংলা একাডেমী পুরস্কার একুশে পদক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার |
দাম্পত্যসঙ্গী | গুলতেকিন আহমেদ (বি. ১৯৭৩; বিচ্ছেদ ২০০৩) মেহের আফরোজ শাওন (বি. ২০০৫–১২) |
সন্তান | নোভা, শীলা আহমেদ, বিপাশা, নুহাশ, নিষাদ, নিনিত |
আত্মীয় | মুহম্মদ জাফর ইকবাল (ভাই) আহসান হাবীব (ভাই) সুফিয়া হায়দার (বোন) মমতাজ শহিদ (বোন) রোকসানা আহমেদ (বোন) |
স্বাক্ষর | ![]() |
ওয়েবসাইট | |
www |
হুমায়ূন আহমেদ (ইংরেজি: Humayun Ahmed, ১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮ – ১৯ জুলাই, ২০১২) বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক গণ্য করা হয়। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার। বলা হয় আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবেও তিনি সমাদৃত। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন শতাধিক। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক। তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত। সত্তর দশকের শেষভাগে থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি তিনি ছিলেন বাংলা গল্প-উপন্যাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কারিগর। এই কালপর্বে তাঁর গল্প-উপন্যাসের জনপ্রিয়তা ছিল তুলনারহিত। তাঁর সৃষ্ট হিমু এবং মিসির আলি ও শুভ্র চরিত্রগুলি বাংলাদেশের যুবকশ্রেণীকে গভীরভাবে উদ্বেলিত করেছে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীও তাঁর সৃষ্টিকর্মের অন্তর্গত। ধরা হয় বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জনপ্রিয়তা তিনি শুরু করেন। তাঁর রচিত প্রথম সায়েন্স ফিকশন “তোমাদের জন্য ভালোবাসা” তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহ পেয়েছে অসামান্য দর্শকপ্রিয়তা। তবে তাঁর টেলিভিশন নাটকগুলি ছিল সর্বাধিক জনপ্রিয়। সংখ্যায় বেশী না হলেও তাঁর রচিত গানগুলোও সবিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর অন্যতম উপন্যাস হলো নন্দিত নরকে, মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, মাতাল হাওয়া ইত্যাদি। তাঁর নির্মিত কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো দুই দুয়ারী, শ্রাবণ মেঘের দিন, ঘেঁটুপুত্র কমলা ইত্যাদি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে দীর্ঘকাল কর্মরত ছিলেন।[৪] লেখালিখি এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বার্থে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাঁকে আটক করে এবং নির্যাতনের পর হত্যার জন্য গুলি চালায়। তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।
জন্ম ও ছেলেবেলা
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত নেত্রকোণা মহুকুমার কেন্দুয়ার কুতুবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শহিদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা ফয়েজ। তাঁর পিতা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও (ইংরেজী: SDPO – Sub-Divisional Police Officer) হিসেবে কর্তব্যরত অবস্থায় শহীদ হন। তাঁর বাবা পত্র-পত্রিকায় লেখালিখি করতেন। বগুড়া থাকার সময় তিনি একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেছিলেন। গ্রন্থের নাম দ্বীপ নেভা যার ঘরে। তাঁর মা’র লেখালিখির অভ্যাস না-থাকলেও একটি আত্ম জীবনী গ্রন্থ রচনা করেছেন যার নাম জীবন যে রকম। তাঁর অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশের একজন বিজ্ঞান শিক্ষক এবং কথাসাহিত্যিক; সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা আহসান হাবীব রম্য সাহিত্যিক এবং কার্টুনিস্ট।
তাঁর রচিত উপন্যাস থেকে জানা যায় যে ছোটকালে হুমায়ূন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান; ডাকনাম কাজল। তাঁর পিতা (ফয়জুর রহমান) নিজের নামের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রাখেন শামসুর রহমান। পরবর্তীতে আবার তিনি নিজেই ছেলের নাম পরিবর্তন করে হুমায়ূন আহমেদ রাখেন। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, তাঁর পিতা ছেলে-মেয়েদের নাম পরিবর্তন করতে পছন্দ করতেন। তাঁর ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম আগে ছিল বাবুল এবং ছোটবোন সুফিয়ার নাম ছিল শেফালি। ১৯৬২-৬৪ সালে চট্টগ্রামে থাকাকালে হুমায়ুন আহমেদের নাম ছিল বাচ্চু।
শিক্ষা এবং কর্মজীবন
তাঁর বাবা চাকুরী সূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেছেন বিধায় হুমায়ূন আহমেদ দেশের বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তিনি পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিজ্ঞানে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং ৫৬৪ নং কক্ষে তার ছাত্রজীবন অতিবাহিত করেন। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী তোমাদের জন্য ভালোবাসা রচনা করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। লেখালেখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় একসময় তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দেন৷ শিক্ষক হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন এই অধ্যাপক৷
সাহিত্যকৃতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনে একটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য জীবনের শুরু। এই উপন্যাসটির নাম নন্দিত নরকে। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপন্যাসটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২-এ কবি-সাহিত্যিক আহমদ ছফার উদ্যোগে উপন্যাসটি খান ব্রাদার্স কর্তৃক গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রখ্যাত বাংলা ভাষাশাস্ত্র পণ্ডিত আহমদ শরীফ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখে দিলে বাংলাদেশের সাহিত্যামোদী মহলে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। শঙ্খনীল কারাগার তাঁর ২য় গ্রন্থ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দুই শতাধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস রচনা করেছেন। তাঁর রচনার প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো ‘গল্প-সমৃদ্ধি’। এছাড়া তিনি অনায়াসে ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে অতিবাস্তব ঘটনাবলীর অবতারণা করেন যাকে একরূপ যাদু বাস্তবতা হিসেবে গণ্য করা যায়। তাঁর গল্প ও উপন্যাস সংলাপপ্রধান। তাঁর বর্ণনা পরিমিত এবং সামান্য পরিসরে কয়েকটি মাত্র বাক্যের মাধ্যমে চরিত্র চিত্রণের অদৃষ্টপূর্ব প্রতিভা তাঁর রয়েছে। যদিও সমাজসচেতনতার অভাব নেই তবু লক্ষ্যণীয় যে তাঁর রচনায় রাজনৈতিক প্রণোদনা অনুপস্থিত। সকল রচনাতেই একটি প্রগাঢ় শুভবোধ ক্রিয়াশীল থাকে; ফলে ‘নেতিবাচক’ চরিত্রও তাঁর লেখনীতে লাভ করে দরদী রূপায়ণ। এ বিষয়ে তিনি মার্কিন লেখক স্টেইনবেক দ্বারা প্রভাবিত। অনেক রচনার মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির প্রচ্ছাপ লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস মধ্যাহ্ন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে পরিগণিত। এছাড়া জোছনা ও জননীর গল্প আরেকটি বড় মাপের রচনা, যা কি-না ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বন করে রচিত। তবে সাধারণত তিনি সমসাময়িক ঘটনাবলী নিয়ে লিখে থাকেন।
পারিবারিক জীবন
হুমায়ূন আহমেদের প্রথমা স্ত্রীর নাম গুলতেকিন আহমেদ। তাঁদের বিয়ে হয় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে। এই দম্পতির তিন মেয়ে এবং এক ছেলে। তিন মেয়ের নাম বিপাশা আহমেদ, নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ এবং ছেলের নাম নুহাশ আহমেদ। অন্য আরেকটি ছেলে অকালে মারা যায়। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগ থেকে শীলার বান্ধবী এবং তার বেশ কিছু নাটক-চলচ্চিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রী শাওনের সাথে হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। এর ফলে সৃষ্ট পারিবারিক অশান্তির অবসানকল্পে ২০০৫-এ গুলতেকিনের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয় এবং ঐ বছরই শাওনকে বিয়ে করেন। এ ঘরে তাদের তিন ছেলে-মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রথম ভূমিষ্ঠ কন্যাটি মারা যায়। ছেলেদের নাম নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ূন।
ব্যক্তি জীবন
জীবনের শেষভাগে ঢাকা শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডির ৩/এ রোডে নির্মিত দখিন হাওয়া ভবনের একটি ফ্লাটে তিনি বসবাস করতেন। খুব ভোর বেলা ওঠা অভ্যাস ছিল তাঁর, ভোর থেকে সকাল ১০-১১ অবধি লিখতেন তিনি। মাটিতে বসে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। কখনো অবসর পেলে ছবি আঁকতেন। জীবনের শেষ এক যুগ ঢাকার অদূরে গাজীপুরের গ্রামাঞ্চলে ৯০ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত বাগান বাড়ী ‘নুহাশ পল্লীতে‘ থাকতে ভালোবাসতেন তিনি। তিনি বিবরবাসী মানুষ; তবে মজলিশী ছিলেন। গল্প বলতে আর রসিকতা করতে খুব পছন্দ করতেন। তিনি ভণিতাবিহীন ছিলেন। নীরবে মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি ও আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করা তার শখ। তবে সাহিত্য পরিমণ্ডলের সঙ্কীর্ণ রাজনীতি বা দলাদলিতে তিনি কখনো নিজেকে জড়িয়ে ফেলেননি। তিনি স্বল্পবাক, কিছুটা লাজুক প্রকৃতির মানুষ এবং বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও অন্তরাল জীবন-যাপনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তবে নিঃসঙ্গতা খুব একটা পছন্দ করতেন না। কোথাও গেলে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে যেতে পছন্দ করতেন। বাংলাদেশে তাঁর প্রভাব তীব্র ও গভীর; এজন্য জাতীয় বিষয়ে ও সঙ্কটে প্রায়ই তাঁর বক্তব্য সংবাদ মাধ্যমসমূহ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে থাকতো। অতুলনীয় জনপ্রিয়তা সত্বেও তিনি অন্তরাল জীবন-যাপন করেন এবং লেখালেখি ও চিত্রনির্মাণের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন।
চলচ্চিত্র নির্মাণ
টেলিভিশনের জন্য একের পর এক দর্শক-নন্দিত নাটক রচনার পর হুমায়ূন আহমেদ ১৯৯০-এর গোড়ার দিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। ২০০০ সালে শ্রাবণ মেঘের দিন ও ২০০১ সালেদুই দুয়ারী চলচ্চিত্র দুটি প্রথম শ্রেনীর দর্শকদের কাছে দারুন গ্রহণযোগ্যতা পায়। ২০০৩-এ নির্মান করেন চন্দ্রকথা নামে একটি চলচ্চিত্র। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালে নির্মান করেন শ্যামল ছায়া চলচ্চিত্রটি। এটি ২০০৬ সালে “সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র” বিভাগে একাডেমি পুরস্কার এর জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। এছাড়াও চলচ্চিত্রটি কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়।[৮] তাঁর সব চলচ্চিত্রে তিনি নিজে গান রচনা করেন। ২০০৮-এ আমার আছে জল চলচ্চিত্রটি তিনি পরিচালনা করেন। ২০১২ সালে তাঁর পরিচালনার সর্বশেষ ছবি ঘেটুপুত্র কমলা (চলচ্চিত্র)।
এছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে ২০০৬ সালে মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত দুরত্ব, বেলাল আহমেদ পরিচালিত নন্দিত নরকে এবং আবু সাইদ পরিচালিত নিরন্তর। ২০০৭-এ শাহ আলম কিরণ পরিচালিত সাজঘর এবং তৌকির আহমেদ নির্মাণ করেন বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র দারুচিনি দ্বীপ।
চলচ্চিত্র
বাংলা চলচিত্রে হুমায়ুন আহম্মেদ একাধারে চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক। তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র গুলো হলো
চলচিত্রের নাম | মুক্তির সাল | ভূমিকা | টীকা |
---|---|---|---|
শঙ্খনীল কারাগার | ১৯৯২ | চিত্রনাট্যকার | মুস্তাফিজুর রহমান পরিচালিত বিজয়ী: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার |
আগুনের পরশমণি | ১৯৯৪ | চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক | বিজয়ী: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ প্রযোজক, কাহিনীকার, ও সংলাপ রচয়িতা |
শ্রাবণ মেঘের দিন | ১৯৯৯ | চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক | |
দুই দুয়ারী | ২০০০ | চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক | |
চন্দ্রকথা | ২০০৩ | চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক | |
শ্যামল ছায়া | ২০০৪ | চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক | ৮৬তম অস্কার প্রতিযোগীতায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে |
দূরত্ব | ২০০৬ | চিত্রনাট্যকার | মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত |
নন্দিত নরকে | ২০০৬ | চিত্রনাট্যকার | বেলাল আহমেদ পরিচালিত |
নিরন্তর | ২০০৬ | চিত্রনাট্যকার | আবু সাইয়ীদ পরিচালিত |
নয় নম্বর বিপদ সংকেত | ২০০৬ | চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক | |
দারুচিনি দ্বীপ | ২০০৭ | চিত্রনাট্যকার | তৌকির আহমেদ পরিচালিত বিজয়ী: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার |
সাজঘর | ২০০৭ | চিত্রনাট্যকার | শাহ আলম কিরণ পরিচালিত |
আমার আছে জল | ২০০৮ | চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক | |
প্রিয়তমেষু | ২০০৯ | চিত্রনাট্যকার | মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত |
ঘেটু পুত্র কমলা | ২০১২ | চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক | বিজয়ী: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার[৯] |
অনিল বাগচীর একদিন (মরণোত্তর) | ২০১৫ | চিত্রনাট্য | মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত। |
টেলিভিশন
তিনি ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য টেলিভিশন ধারাবাহিক এবং টেলিফিল্ম রচনা শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে তার প্রথম টিভি কাহিনীচিত্র প্রথম প্রহর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এটি তাঁকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে।
তাঁর অন্যতম টেলিভিশন ধারাবাহিক –
- এইসব দিন রাত্রি
- বহুব্রীহি
- কোথাও কেউ নেই
- নক্ষত্রের রাত
- অয়োময়
- আজ রবিবার
- নিমফুল
- তারা তিনজন
- আমরা তিনজন
- মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম
- সবুজ সাথী
- উড়ে যায় বকপঙ্খী
- এই মেঘ এই রৌদ্র
পরবর্তি সময়ে তিনি বহু এক পর্বের নাটক নির্মাণ করেছেন। যাদের মধ্যে খেলা, অচিন বৃক্ষ, খাদক, একি কান্ড, একদিন হঠাৎ, অন্যভুবন উল্লেখযোগ্য।[১০]
গান রচনা
হুমায়ূন আহমেদ মূলতঃ গান রচয়িতা বা গীতিকার নন। কেবল নাটক ও চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে তিনি গান রচনা করে থাকেন। তার অনেকগুলো গান বেশ জনপ্রিয়। এসবের এ্যালবামও প্রকাশিত হয়েছে।
গ্রন্থতালিকা
নির্বাচিত উপন্যাস
- নন্দিত নরকে (১৯৭২)
- শঙ্খনীল কারাগার (১৯৭৮)
- আমার আছে জল (১৯৮৫)
- সম্রাট (১৯৮৮)
- সাজঘর (১৯৮৯)
- আকাশ জোড়া মেঘ (১৯৮৯)
- এইসব দিনরাত্রি (১৯৯০)
- অয়োময় (১৯৯০)
- জনম জনম (১৯৯০)
- বহুব্রীহি (১৯৯০)
- আশাবরী (১৯৯১)
- কোথাও কেউ নেই (১৯৯২)
- কৃষ্ণপক্ষ (১৯৯২)
- মন্দ্রসপ্তক (১৯৯৩)
- আমার আপন আঁধার (১৯৯৩)
- আমি এবং আমরা (১৯৯৩)
- শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৪)
- গৌরীপুর জংশন (১৯৯৫)
- পেন্সিলে আঁকা পরী (১৯৯৫)
- কবি (১৯৯৬)
- ফেরা (১৯৯৬)
- মহাপুরুষ (১৯৯৬)
- অপেক্ষা (১৯৯৭)
- অন্ধকারের গান (১৯৯৭)
- মেঘ বলেছে যাবো যাবো (১৯৯৭)
- দূরে কোথাও (১৯৯৭)
- চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস (১৯৯৮)
- ইস্টিশন (১৯৯৯)
- বৃষ্টিবিলাস (২০০০)
- মৃণ্ময়ী (২০০১)
- তেঁতুল বনে জোছনা (২০০১)
- কুটু মিয়া (২০০১)
- একজন মায়াবতী (২০০২)
- আসমানিরা তিন বোন (২০০২)
- বাসর (২০০২)
- অচিনপুর (২০০২)
- নক্ষত্রের রাত (২০০৩)
- এপিটাফ (২০০৪)
- লিলাবতী (২০০৫)
- কে কথা কয় (২০০৬)
- লিলুয়া বাতাস (২০০৬)
- মৃণ্ময়ীর মন ভালো নেই (২০০৬)
- মধ্যাহ্ন (২ খণ্ড) (২০০৮)
- আনন্দ বেদনার কাব্য (২০০৮)
- অন্যদিন (২০০৯)
- অমানুষ (অনুবাদ) (২০০৯)
- চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক (২০০৯)
- বিরহগাঁথা – ১, ২, ৩ (২০০৯)
- মাতাল হাওয়া (২০১০)
- ম্যজিক মুনসি (২০১০)
- বাদশাহ নামদার (২০১১)
- আমরা কেউ বাসায় নেই (২০১২)
- মেঘের ওপর বাড়ি (২০১২)
নাটক
- নৃপতি (১৯৯১)
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও রাজনৈতিক উপন্যাস
- সৌরভ (১৯৮৪)
- আগুনের পরশমণি (১৯৮৬)
- অনিল বাগচীর একদিন (১৯৯২)
- ১৯৭১ (১৯৯৫)
- শ্যামল ছায়া (২০০৩)
- জোছনা ও জননীর গল্প (২০০৪)
- দেয়াল (২০১২)\
হিমু সংক্রান্ত উপন্যাস
- ময়ুরাক্ষী (১৯৯০)
- দরজার ওপাশে (১৯৯২)
- হিমু (১৯৯৩)
- পারাপার (১৯৯৩)
- এবং হিমু (১৯৯৫)
- হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম (১৯৯৬)
- হিমুর দ্বিতীয় প্রহর (১৯৯৭)
- হিমুর রুপালী রাত্রি (১৯৯৮)
- একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁঝিঁ পোকা (১৯৯৯)
- তোমাদের এই নগরে (২০০০)
- চলে যায় বসন্তের দিন (২০০২)
- সে আসে ধীরে (২০০৩)
- হিমু মামা (২০০৪)
- আঙ্গুল কাটা জগলু (২০০৫)
- হলুদ হিমু কালো র্যাব (২০০৬)
- আজ হিমুর বিয়ে (২০০৭)
- হিমু রিমান্ডে (২০০৮)
- হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য (২০০৮)
- হিমুর বাবার কথামালা (২০০৯)
- হিমুর মধ্যদুপুর (২০০৯)
- হিমুর নীল জোছনা (২০১০)
- হিমুর আছে জল (২০১১)
- হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী (২০১১)
- হিমু এবং হার্ভার্ড পিএইচ.ডি. বল্টু ভাই (২০১২)
মিসির আলি সংক্রান্ত উপন্যাস
- দেবী (১৯৮৫)
- নিশিথিনী (১৯৮৭)
- অন্যভুবন (১৯৮৭)
- নিষাদ (১৯৮৯)
- বৃহন্নলা (১৯৮৯)
- ভয় (১৯৯১)
- বিপদ (১৯৯২)
- অনীশ (১৯৯২)
- মিসির আলির অমিমাংসিত রহস্য (১৯৯৬)
- তন্দ্রাবিলাস
- আমিই মিসির আলি (২০০০)
- বাঘবন্দী মিসির আলি (২০০১)
- হরতন ইশকাপন (২০০৮)
- মিসির আলির চশমা (২০০৮)
- কহেন কবি কালিদাস (২০০৯)
- মিসির আলি!আপনি কোথায়? (২০০৯)
- মিসির আলি আনসলভ (২০১০)
- যখন নামিবে আঁধার (২০১২)
শুভ্র সংক্রান্ত উপন্যাস
- দারুচিনি দ্বীপ (১৯৯১)
- রূপালী দ্বীপ (১৯৯৪)
- শুভ্র (২০০০)
- এই শুভ্র! এই (২০০৩)
- শুভ্র গেছে বনে (২০১০)
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
- নি
- শূন্য
- ওমেগা পয়েন্ট
- ইমা
- দ্বিতীয় মানব
- ওরা তিন জন
আত্মজীবনী
- বলপয়েন্ট
- কাঠপেন্সিল (২০১০)
- ফাউন্টেইন পেন
- রংপেনসিল (২০১১)
- নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ (২০১২)
- হোটেল গ্রেভার ইন
- আমার ছেলেবেলা
- হিজিবিজি (২০১৩)
- আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই (সংকলন)
- লীলাবতির মৃত্যু(২০১৪)
জীবনী
- নবীজি (২০১২) (অপ্রকাশিত ও অসমাপ্ত রচনা)
পুরস্কার
হুমায়ুন আহমেদ তাঁর অসংখ্য বহুমাত্রিক সৃষ্টির জন্য নানা পুরস্কারে ভূষিত হন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলি হলোঃ
- বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১)
- শিশু একাডেমী পুরস্কার
- একুশে পদক (১৯৯৪)
- জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ কাহিনী ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ সংলাপ ১৯৯৪)
- লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩)
- মাইকেল মধুসুদন পদক (১৯৮৭)
- বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮)
- হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০)
- জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক
হুমায়ুন আহমেদের নামে সাহিত্য পুরস্কার
এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিনের যৌথ উদ্যোগে হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে।
ক্যান্সার ও মৃত্যু
২০১১-এর সেপ্টেম্বের মাসে সিঙ্গাপুরে ডাক্তারী চিকিৎসার সময় তাঁর দেহে মলাশয়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। তিনি নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোয়ান-কেটরিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসা গ্রহণ করেন।তবে টিউমার বাইরে ছড়িয়ে না-পড়ায় সহজে তাঁর চিকিৎসা প্রাথমিকভাবে সম্ভব হলেও অল্প সময়ের মাঝেই তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ১২ দফায় তাঁকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর তাঁর কিছুটা শারীরিক উন্নতি হলেও, শেষ মুহূর্তে শরীরে অজ্ঞাত ভাইরাস আক্রমণ করায় তার অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যায়। কৃত্রিমভাবে লাইভ সাপোর্টে রাখার পর ১৯ জুলাই ২০১২ তারিখে হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন। মলাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০১২ সালের ১৯ জুলাই-এ স্থানীয় সময় ১১:২০ মিনিটে নিউ ইয়র্কের বেলেভ্যু হসপিটালে এই নন্দিত লেখক মৃত্যুবরণ করেন। তাকে নুহাশ পল্লীতে দাফন করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে সারা বাংলাদেশে সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব আহাজারির সৃষ্টি হয়। তাঁর মৃত্যুর ফলে বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র অঙ্গনে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়।