হৃদরোগে পেইসমেকারের গুরুত্ব

ডা: আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার:

মানুষের হৃৎপিণ্ড একটাই। কিন্তু এর অসুখ আছে শত শত। আর এর প্রতিকারও হয় ভিন্ন ভিন্ন। হৃৎপিণ্ডের ভাল্ব, মাংসপেশি বা রক্তনালীর সম্বন্ধে আমরা শিক্ষিত সমাজের সবাই কমবেশি কিছু না কিছু জ্ঞান রাখি। কিন্তু হৃৎস্পন্দনের অসুখ সম্বন্ধে জনসাধারণের জ্ঞান সীমিত। আজ এমনই কতগুলো হৃৎস্পন্দনের অসুখ ও তার প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব।

হৃৎস্পন্দনজনিত রোগগুলোকে প্রধানত : দু’টি শ্রেণীতে ভাগ করা হয় :
১. ব্র্যাডিঅ্যারিদমিয়াস বা ধীর গতির হৃৎস্পন্দন।
২. ট্যাকিঅ্যারিদমিয়াস বা দ্রুত গতির হৃৎস্পন্দন।
ব্র্যাডিঅ্যারিদমিয়ার মধ্যে আবার অনেক রোগ রয়েছে যার মধ্যে কমপ্লিট হার্ট ব্লক এবং সিক সাইনাস সিনড্রোম উল্লেখযোগ্য।

সব ধরনের ব্র্যাডিঅ্যারিদমিয়া মোটামুটি একই রকম উপসর্গের সৃষ্টি করে, যেমন- মাথা ঘুরানো, মাথা ঝিমঝিম করা, মাথা ঘুরে পরে যাওয়া, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এই উপসর্গগুলো সাধারণত পরিশ্রম করার সময় বেশি হয়। যখন এই উপসর্গগুলো হয় তখন মুখ ও হাত-পা ফ্যাকাশে দেখা যায়, শরীর ঘামতে থাকে ও ঠাণ্ডা হয়ে যায়, নাড়ির ধীর গতি থাকে এবং রক্তচাপ অনেক কমে যায়।
ব্র্যাডিঅ্যারিদমিয়া রোগগুলো নির্ণয় করা হয় রোগের উপসর্গ, লক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে ইসিজি ও ২৪ ঘণ্টার হল্টার মনিটরিং অন্যতম। তা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক অন্য ধরনের হৃদরোগ নির্ণয় করার জন্য বুকের এক্সরে ও ইকোকার্ডিওগ্রাফি করা হয়ে থাকে। যাদের পরিশ্রম করলে উপসর্গ দেখা দেয়, ইটিটি তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা।
কোনো কোনো ব্র্যাডিঅ্যারিদমিয়া আছে যারা সাধারণত কোনো উপসর্গ করে না এবং এগুলো নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার সময় ধরা পরে। রোগীর যদি কোনো উপসর্গ না থাকে, তা হলে কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাকে সতর্ক থাকতে হবে; যখনই কোনো রকম অসুবিধা অনুভূত হবে তখনই একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। যেকোনো ধরনের ব্র্যাডিঅ্যারিদমিয়া যদি উপসর্গের সৃষ্টি করে, বিশেষ করে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, তাহলে শরীরে পেইসমেকার বসাতে হবে। সাধারণত কমপ্লিট হার্ট ব্লক বা সিক মাইনাম সিনড্রোম রোগে এ ধনের উপসর্গ বেশি করে থাকে।

এখন সবারই মনে প্রশ্ন আসবে এই পেইসমেকার জিনিসটা কী? পেইসমেকার হলো ছোট একটি ইলেট্রনিক যন্ত্র বিশেষ, যা বুকের উপরিভাগের ডান অথবা বাম পাশে চামড়ার নিচে বসানো হয়। যারা ডান হাতে কাজ করেন তাদের বাম দিকে এবং যারা বাম হাতে কাজ করেন তাদের ডান দিকে লাগানো হয়ে থাকে। পেইসমেকার কয়েক প্রকার হয়ে থাকে।
১. সিঙ্গল চেম্বার
২. ডুয়াল চেম্বার
পেইসমেকার থেকে বিশেষ তারের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠে সংযোগ দেয়া হয়। উপরোল্লিখিত প্রকারভেদে একটা থেকে তিনটা লিড সিস্টেমের প্রয়োজন হয়। রোগের প্রকারভেদে এক এক ধরনের পেইসমেকার লাগানো হয়ে থাকে।

পেইসমেকার ইমপ্ল্যানন্টেশনের পর একজন রোগীকে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। সেগুলো নিম্নরূপ :
১. যে পাশে পেইসমেকার বসানো হয় সেই পাশের হাত কাঁধের ওপর উঠাবে না।
২. ওই হাত দিয়ে ছয় মাস ভারী বস্তু বহন করবে না।
৩. ওই পাশের কানে মোবাইল ফোন ব্যবহার করবে না।
৪. মাইক্রোওয়েভ ওভেন বা টেলিভিশনের কাছে যাবে না।
৫. এমআরআই পরীক্ষা করা যাবে না।
৬. যেকোনো ডাক্তারের পরামর্শ নেয়ার সময় ডাক্তারকে জানাতে হবে যে উনার শরীরে পেইসমেকার বসানো আছে।
৭. পেইসমেকার বসানোর দিন থেকে ১, ৩, ৬ ও ১২ মাস পর হাসপাতালে এসে পেইসমেকার ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা পরীক্ষা করাতে হবে। তার পর বছরে একবার করে পরীক্ষা করাতে হবে।

লেখক : শিশু কার্ডিওলজি বিভাগ, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.