হেলেন কেলারের চিঠি

উনিশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী, বাক ও দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী হেলেন কেলার। তাকে ছোট বয়সে দূরালাপনী আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। বিজ্ঞানী গ্রাহাম বেল নিশ্চিত করেছিলেন হেলেন কখনই দেখতে ও শুনতে পারবেন না। কিন্তু পরিচয় পেয়েছিলেন তার ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার। বিজ্ঞানীর পরামর্শে হেলেনের জন্য আলাদাভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে তিনি নিজেকে গড়ে তুলে সৃষ্টিশীল-সৃজনশীল কর্মে নিয়োজিত হতে থাকেন। প্রথম অর্কেস্ট্রা সংগীত অনুভব করার সুযোগ পেয়েছিলেন নিউইয়র্ক সিম্ফোনি অর্কেস্ট্রা সংস্থার আয়োজিত বেটোফেনের ‘নাইনথ সিম্ফোনি’র মাধ্যমে। এটি একটি রেডিও অনুষ্ঠান। কৃতজ্ঞ হেলেন তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে লিখে ফেললেন এ চিঠি—

৯৩ মিসিনল এভিনিউ

ফরেস্ট গিল, এল. আই

ফেব্রুয়ারি ২, ১৯২৪

দ্য নিউইয়র্ক সিম্ফোনি অর্কেস্ট্রা, নিউইয়র্ক সিটি

প্রিয় সঙ্গীরা আমার,

বধির এবং অন্ধ আমি। তা সত্ত্বেও খুব খুশি হয়ে আপনাদের জানাতে চাই, কাল রাতে কয়েক ঘণ্টা রেডিওতে বেটোফেনের নাইট সিম্ফোনি শুনে আমি মুগ্ধ! বাকিরা যেভাবে শুনেছেন; বলছি না আমি ঠিক সেইভাবে ‘শুনেছি’। আমি বোঝাতেও পারব না কীভাবে ছন্দময় সুর অনুভব করতে পেরেছি, সুখের অনুভূতি পেয়েছি। আমার নিজের কাছেই বিষয়টি অবাক লাগছে। রেডিওর দেখার ক্ষমতা নেই। তাই সে নিজেই দৃষ্টিহীন।

অন্ধরা নতুন এক বিনোদন মাধ্যমের বদৌলতে আনন্দের স্পর্শ পাচ্ছে জেনে ভালো লেগেছে। এ বস্তুটি আমার জীবনে আনন্দের ধারা বয়ে আনতে সক্ষম। কাল রাতে আমরা পরিবারের সবাই মিলে আপনাদের পরিবেশিত অসাধারণ সিম্ফোনি শুনেছি। একজন পরামর্শ দিলেন, আমার হাতটি রেডিওর সাউন্ড বক্সের ওপর রেখে সংগীতের কম্পন অনুভব করতে। তিনি যন্ত্রটির বাক্স খুলে দিলে আস্তে করে পাতলা পর্দাটি স্পর্শ করি। এতে আমি যেন এক অন্য জগতে প্রবেশ করলাম! শুধু সংগীতের কম্পন নয়; আমার মাঝে দোল দিতে লাগল সংগীতের তাল, স্পন্দন, আবেগ। বিভিন্ন যন্ত্রের সুরের মূর্ছনা আমাকে বশীভূত করে ফেলেছিল। বাঁশির সুর, ঢাকের বাজনা, বেহালা ও বীণার তালের সঙ্গে গানের সূক্ষ্ম মিশেলের পার্থক্য স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। গায়কদলের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ, ভাবাবেশ যেন অগ্নিশিখার মতো আমার বুকের পাঁজরে প্রবেশ করে। সংগীতে একজন নারীর কণ্ঠস্বর স্বর্গদূতের কণ্ঠ হিসেবে আমার মনে ধরা দেয়। সুরের বন্যায় হূদয়-মন ভাসিয়ে দেয়। এর পর বাদ্যযন্ত্রের তাল-লয় ও মানুষের কণ্ঠস্বর এক হয়ে তৈরি করে সমুদ্রের উদ্বেলিত স্রোতের কম্পন।

এভাবে সংগীত উপভোগ করাকে সংগীত ‘শোনা’ বলে না। কিন্তু ছন্দ ও সুর আমার কাছে লাবণ্য ও মহিমার মূর্ত প্রতীক হিসেবে হাজির হয়। অনুভব করেছি কিংবা বলতে গেলে ধারণা করেই বলছি, প্রকৃতির অমলিন ছন্দ আমার মস্তিষ্কে সুরের ঝংকার সৃষ্টি করে। বাঁশবনের ভেতরের ঝড়ো হাওয়া, পাতার মর্মর ধ্বনি আমার মধ্যে সংগীতের জাগরণ ঘটায়। এতগুলো যন্ত্রের ছন্দময় গতি আগে কখনো অনুভব করিনি।

আঁধারের দৌরাত্ম্য ও সংগীতের মাধুর্যের মাঝে আমার ঘরে সুরের মায়া ছড়িয়ে পড়ছিল। এর মধ্যে আমি কোনোভাবেই মনে করতে পারছিলাম না সেই ব্যক্তির নাম, যার সুরের জগতে প্রবেশ করে আমার মতো বধিরও মিষ্টিমধুর অভিজ্ঞতা লাভ করতে পেরেছে। নিজের কষ্টগুলোকে জীর্ণ করে সংগীতের মাধ্যমে তিনি নিজের ও অন্যদের আনন্দের খোরাক জোগাচ্ছেন। আমার হাত এখনো ছুঁয়ে যাচ্ছে তার সৃষ্টির বিমোহিত সুর; সংগীতের আবেশ যেন সমুদ্রের স্রোতের ধ্বনির মতো।

নিজের ঘরে বসে আপনাদের পরিবেশিত এত সুন্দর সংগীত উপভোগ করার সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য। স্টেশন ডব্লিউইএএফকে ধন্যবাদ জানাতে চাই বিশ্বমানের সংগীত আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য।

আন্তরিক শুভেচ্ছা,

হেলেন কেলার

ভাষান্তর: তাবাস্সুম আরজু

 

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

হেলেন কেলার
হেলেন অ্যাডামস কেলার ১৯০৮ সালে
জন্মজুন ২৭, ১৮৮০
আলাবামা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মৃত্যু১ জুন ১৯৬৮ (৮৭ বছর)
আরকেন রেডজ, কানেটিকাট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
জাতীয়তাআমেরিকান
পেশালেখক, রাজনৈতিক কর্মী, মানবতাবাদী
স্বাক্ষর

হেলেন কেলার বা হেলেন অ্যাডামস কেলার (ইংরেজি: Helen Adams Keller) (২৭শে জুন, ১৮৮০১লা জুন, ১৯৬৮) বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকারের জন্য আজীবন লড়াই করেছেন। একই সাথে তিনি ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ন লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী।

পরিচ্ছেদসমূহ

জীবনী

শৈশব

জুলাই ১৮৮৮ সালে হেলেন অ্যানা সেলভেন সাথে কেপ কাডেতে

হেলেন কেলার ১৮৮০ সালের ২৭ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আর্থার কেলার[১] এবং মায়ের নাম কেইট আডামস[২]। বয়স যখন মাত্র ১৯ মাস তখন তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবা-মা প্রাণের প্রিয় কন্যার জীবনের আশা-ভরসা ছেড়ে দিলেও ভেঙে পড়েননি; চিকিৎসা করা শুরু করেন। বহু চিকিৎসার পর হেলেনের জীবন রক্ষা পায়। কিন্তু তার কথা বলা, শোনা এবং দেখার শক্তি চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়।

শিশুকাল থেকেই হেলেন কেলার একাধারে বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিত্বের শিকার হয়ে বহুমুখী প্রতিবন্ধিত্ব নিয়েই বড় হতে থাকেন। তার বয়স যখন মাত্র ছয় বছর তখন বাবা-মা তাকে ওয়াশিংটনের প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী[৩], টেলিফোন আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের কাছে পরামর্শ গ্রহণের জন্য নিয়ে যান। তিনি হেলেন কেলারকে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন, হেলেন আর কোনো দিন চোখে দেখতে পাবে না এবং কানেও শুনতে পাবে না। তবে গ্রাহাম বেল হেলেন কেলারের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা দেখে অনুধাবন করেন পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে স্বাভাবিক জীবনের কাছাকাছি একটি সুন্দর জীবন ফিরে পাওয়া সম্ভব।

কেলার এবং আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল, ১৯০২[৪]

শিক্ষাজীবন

হেলেন এবং অ্যানা সেলভেন ১৮৯৮ সালে

আট বছর বয়সে এনি সুলিভান নামের এক গৃহশিক্ষিকা তার পড়াশোনার দায়িত্ব নেন। এখান থেকেই তাদের ৪৯ বছরের সম্পর্কের শুরু। এনি নিজেও একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি ছিলেন। এনি প্রথমে আঙুল দিয়ে হেলেনের হাতে বিভিন্ন চিহ্ন এঁকে এবং এরপর বর্ণমালা কার্ড দিয়ে বর্ণমালা শেখান। তারপর ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করেন। ১০ বছর বয়সে নরওয়েতে উদ্ভাবিত এক পদ্ধতি অনুসরণ করে কথা বলা শেখেন হেলেন। ১৯০০ সালে রেডক্লিফ কলেজে ভর্তি হন যেখানে বিশ্ববিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েনের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। ১৯০৪ সালে হেলেন প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ডিগ্রি অর্জনের আগেই তার আত্মজীবনী দ্যা স্টোরি অব মাই লাইফ প্রকাশিত হয়।

সমাজসেবা

সমাজের বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও গণমানুষের সহায়তা অর্জনে হেলেন প্রচেষ্টা চালান। এতে তিনি ব্যাপক সফলতাও লাভ করেন। তার জীবদ্দশায় যুক্তরাষ্ট্রের সকল প্রেসিডেন্টের এবং আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল, মার্ক টোয়েন, চার্লি চ্যাপলিনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের সহায়তা পান।

হেলেন ১৯১৫ সালে জর্জ কেসলারকে সাথে নিয়ে হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। সংস্থাটি এখনও বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের অনুরোধে হেলেন কেলার বিভিন্ন হাসপাতালে যুদ্ধাহত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নাবিক ও সৈনিকদের দেখতে যেতেন এবং শান্তি ও আশার বাণী শোনাতেন। যুদ্ধ শেষ হলে বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশ্বব্যাপী এক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস পান।

সাহিত্যকর্ম

তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ১২ টি। প্রধান বই হচ্ছে দি স্টোরি অফ মাই লাইফ (১৯০৩), লেট আস হ্যাভ ফেইথ, দি ওয়ার্ল্ড আই লিভ ইন (১৯০৮)[৫], ওপেন ডোর ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অভিশপ্ত বিড়ম্বনা জীবনের বিষাদের ওপর একটি চলচ্চিত্র (Deliverance-1919) নির্মাণ করেন। চলচ্চিত্রে তার নিজের ভূমিকায় তিনি নিজেই অভিনয় করেছেন।

পাদটীকা

  • Keller, Helen with Anne Sullivan and John A. Macy (1903) The Story of My Life. New York, NY: Doubleday, Page & Co.
  • Lash, Joseph P. (1980) Helen and Teacher: The Story of Helen Keller and Anne Sullivan Macy . New York, NY: Delacorte Press. ISBN 0-440-03654-2
  • Herrmann, Dorothy (1998) Helen Keller: A Life. New York, NY: Knopf. ISBN 0-679-44354-1

তথ্যসূত্র

  1. Keller, Helen (২০০৪) [১৯০৮]। The World I Live In (NYRB Classics 2004 সংস্করণ)। New York: NYRB Classics। আইএসবিএন978-1590170670

বহিসংযোগ

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.