২০৩৩ পর্যন্ত মেধাস্বত্ব ছাড় পেল বাংলাদেশ
ওষুধ শিল্প
২০৩৩ পর্যন্ত মেধাস্বত্ব ছাড় পেল বাংলাদেশ
২০৩৩ সাল পর্যন্ত ওষুধ শিল্পে মেধাস্বত্বে ছাড় পেয়েছে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত সদস্য দেশগুলো (এলডিসি)। ৬ নভেম্বর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার (ট্রিপস) কাউন্সিল এ সিদ্ধান্ত নেয়। এতে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি ও রফতানি বাজার হারানোর যে ঝুঁকি ছিল, তা থেকে আপাতত মুক্ত হলো বাংলাদেশ।
ট্রিপস কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০৩৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যে মেধাস্বত্ব নীতি প্রযোজ্য হবে না। এ সিদ্ধান্তের ফলে এলডিসিভুক্ত দেশগুলো এ সময়ে ফার্মাসিউটিক্যাল পেটেন্ট ও ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার তথ্য সংরক্ষণ করার বিষয়ে স্বাধীনতা ভোগ করবে। দেশগুলোর জন্য এ সুযোগ আরো বাড়ানোর পথও খোলা রাখা হয়েছে এ সিদ্ধান্তে।
মেধাস্বত্ব অধিকার সংরক্ষণ ডব্লিউটিওর একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এলডিসিভুক্ত দেশগুলোকে মেধাস্বত্ব ছাড়ের সুবিধা দেয়া হলো। এর আগে ২০০১ সালে ট্রিপস সমঝোতা ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক ডব্লিউটিওর সদস্য দেশগুলোর মন্ত্রী পর্যায়ের দোহা ঘোষণায় এ সম্পর্কিত একটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এর মেয়াদ আগামী ৩১ ডিসেম্বর শেষ হচ্ছে।
নতুন ঘোষণায় জাতিসংঘের নেয়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে (এসডিজি) অনুসরণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রায় সবার জন্য ওষুধের নিশ্চয়তা দিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি ট্রিপস সমঝোতায় নমনীয়তা দেখানোর কথা বলা হয়।
ট্রিপস কাউন্সিল গৃহীত এ সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে ডব্লিউটিওর মহাপরিচালক রবার্তো আজিভেদো বলেন, ট্রিপস কাউন্সিলের এ সিদ্ধান্ত দরিদ্র দেশগুলোর প্রতি ডব্লিউটিও সদস্যদের অঙ্গীকারের একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন। আগামী মাসে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সংকটকে কেন্দ্রে রেখে নাইরোবিতে আমাদের মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন হতে যাচ্ছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও এ চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা এখন ডব্লিউটিওর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
ট্রিপস কাউন্সিলের এ সিদ্ধান্ত ডব্লিউটিওর সাধারণ পরিষদেও অনুসৃত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সাধারণ পরিষদে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর জন্য বিরাজমান বাজার সুবিধা বাড়ানোর কথা রয়েছে। এছাড়া দেশগুলো থেকে আসা পেটেন্ট আবেদন বিবেচনা করার ক্ষেত্রেও সুবিধা প্রদানের সম্ভাবনা রয়েছে। এ দুটি সুবিধাও ২০৩৩ সাল পর্যন্ত প্রদান করা হবে।
ডব্লিউটিওতে এলডিসিভুক্ত দেশের জোট সমন্বয়ক ও নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শামিম আহসান ট্রিপস কাউন্সিল গৃহীত সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক আখ্যা দিয়ে বলেন, এটি স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে জেনেরিক ওষুধ ক্রয় ও উৎপাদনের আইনি নিশ্চয়তা দেবে।
২০৩৩ সাল পর্যন্ত শিথিলকরণের এ সিদ্ধান্ত এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর করা একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নেয়া হয়েছে। জাতিসংঘ ২০৩০ সাল পর্যন্ত নতুন উন্নয়ন কৌশল হিসেবে এসডিজি ঘোষণার এক মাস পরই এ সিদ্ধান্ত এল।
ওষুধ উৎপাদনে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত মেধাস্বত্ব ছাড় পাওয়ার বিষয়ে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সাবেক মহাসচিব আবদুল মোক্তাদির বলেন, ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব্ব ছাড় পাওয়ার খবরটি বাংলাদেশের জন্য খুবই ইতিবাচক। এটা খুবই দরকার ছিল। এতে দেশ ও দেশের জনগণসহ সবাই উপকৃত হবে।
এ বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মো. ইয়াহিয়া বলেন, মেধাস্বত্ব ছাড় পাওয়ার বিষয়টি একটি বিরাট অর্জন বলা যায়। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের নেতা হিসেবে এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। এতে দেশের মানুষ কম দামে যেকোনো ওষুধ কিনতে পারবে। মেধাস্বত্ব সুবিধা উঠে গেলে ৮০ পয়সার একটি প্যারাসিটামল কিনতে হবে আড়াই-তিন টাকায়।
মেধাস্বত্ব ছাড় পাওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ওষুধ ব্যবসায়ীরাও। বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির উপসচিব এসএম মনির হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদনে অনেকটা এগিয়েছে। ২০৩৩ সাল পর্যন্ত মেধাস্বত্ব ছাড় পাওয়ার খবরই নিঃসন্দেহে দেশের জন্য সুখবর। একে কাজে লাগাতে হবে। ২০৩৩ সালের আগেই যাতে বাংলাদেশ সব ধরনের ওষুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে, সেজন্য কোম্পানিগুলোকেও ভূমিকা নিতে হবে।
২০০১ সালের ট্রিপস ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশসহ এলডিসিভুক্ত দেশগুলো বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে সক্ষমতা তৈরির কথা ছিল। যদিও এখনো ওষুধ শিল্পে কাঁচামাল তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ওষুধ পণ্যসংশ্লিষ্ট ট্রিপস চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত নয় বাংলাদেশ। এজন্য স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে মিলে এ সময় বাড়ানোর পক্ষে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হয়েছিল। এক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোকে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নতুন নতুন রোগ দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, মেধাস্বত্ব ছাড় পাওয়ায় বিভিন্ন স্বল্পোন্নত দেশে কম মূল্যে ওষুধ রফতানি করে বাংলাদেশ। এ সুবিধা না থাকলে তা বন্ধ হয়ে যেত।
ওষুধ প্রসাশনের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে ওষুধ তৈরিতে ৯৭ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি হচ্ছে। বাংলাদেশে ১৫টি প্রতিষ্ঠান স্বল্পপরিসরে ৪৩টি ওষুধের কাঁচামাল তৈরি করতে পারে। তাছাড়া ওষুধের গবেষণা ও উন্নয়নেও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। নতুন মলিকিউল তৈরির সক্ষমতা অর্জন হয়নি এখনো। এছাড়া পেটেন্ট আইন এখনো চূড়ান্ত হয়নি। মুন্সীগঞ্জের বাউশিয়ায় ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য এপিআই শিল্প পার্কের কাজ চলছে। এখানে উৎপাদন শুরু হতে ২০১৮ সাল লাগবে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৫ সালে ডব্লিউটিও প্রতিষ্ঠার পরের বছর ট্রিপস চুক্তি সম্পাদন হয়। এ চুক্তির মাধ্যমে ট্রেডমার্ক, কপিরাইট, পেটেন্ট ডিজাইনসহ মেধাস্বত্বের অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য প্রথম দফায় স্বল্পোন্নত দেশের জন্য ১০ বছর সময় দেয়া হয়েছিল। ফার্মাসিউটিক্যালসের বাইরে অন্য ক্ষেত্রে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল, যা পরবর্তীতে আরো আট বছর বাড়ানো হয়েছে।
বণিক বার্তা