২০ হাজার বাংলাদেশী ইউরোপে আশ্রয়প্রার্থী

সুমন আফসার ও তাসনিম মহসিন |
জীবন বাঁচাতে ২০১৪ সাল থেকে ইউরোপে পাড়ি জমাতে শুরু করেন যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার নাগরিক। মানবিক বিবেচনায় তাদের আশ্রয় দেয় ইউরোপের দেশগুলো। এ সুযোগ কাজে লাগাতে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী নাগরিকও ইউরোপে আশ্রয় খুঁজছেন।

পরিসংখ্যান-বিষয়ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দফতর ইউরোস্ট্যাটের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৫-এর অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশী ইউরোপের দেশগুলোয় আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। এর মধ্যে ১০-৫০ শতাংশ বাংলাদেশীর আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। বাংলাদেশীরা এ সময়ে সবচেয়ে বেশি আবেদন করেন ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও আয়ারল্যান্ডে।

জানা গেছে, এর আগে ২০১৪ সালে ইউরোপের দেশগুলোয় আশ্রয় চেয়ে ৩ হাজার ৭৭৫ বাংলাদেশী আবেদন করেছিলেন। এদের সবাই ফ্রান্সের অভিবাসী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশীর সংখ্যা বেড়ে যায়।

গত বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে আয়ারল্যান্ডে আশ্রয়ের আবেদন করেন ৯০ জন বাংলাদেশী। দেশটিতে আশ্রয় চাওয়া বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মধ্যে সংখ্যাটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। একই বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে দেশটিতে আশ্রয় চান ১০০ জন বাংলাদেশী। এ সময়ে ইতালিতে আশ্রয় প্রার্থনা করেন ২ হাজার ৮৩০ জন বাংলাদেশী। এসব আবেদনের ১০-১১ শতাংশ মঞ্জুর করেছে দেশ দুটি।

ইউরোপের শরণার্থী স্রোতের সঙ্গে ভাগ্য পরীক্ষার ঝুঁকি নিচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বাংলাদেশীরাও। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আসা এসব মানুষের অনেকেরই গন্তব্য জার্মানির মিউনিখ। এক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করছে একশ্রেণীর দালাল, যাদের সহযোগিতায় তারা একের পর এক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পৌঁছাচ্ছেন কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। এজন্য লোভনীয় বিজ্ঞাপনও দেয়া হচ্ছে। ২ হাজার ৪০০ ডলারে জার্মানিতে পৌঁছে দেয়ার কথা বলা হচ্ছে বিজ্ঞাপনে।

পশ্চিমা দেশগুলোয় আশ্রয়ের সুযোগ পেয়েছেন, এমন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে তুরস্ক হয়ে জার্মানি কিংবা ইউরোপের অন্য দেশগুলোয় পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশীরা। এছাড়া অনেকেই সাইপ্রাস, গ্রিস ও ইতালি হয়ে ইউরোপের অন্য দেশগুলোয় যাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পাঁচটি রুট দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন বাংলাদেশী ইউরোপে প্রবেশ করছেন। এদের বেশির ভাগই আসছেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে।

জার্মানির মিউনিখে অবস্থানরত এক বাংলাদেশী জানান, দুবাই থেকে তিনি স্থলপথে যান তুরস্কে। সেখান থেকে গ্রিসে গিয়ে থাকেন তিন বছরের বেশি। এর পর বুলগেরিয়া হয়ে পৌঁছান জার্মানি। উন্নত জীবনের আশায় একের পর এক দেশ পাড়ি দিলেও কোনো দেশেই বৈধতা পাননি তিনি। এখন জার্মানিতে আছেন বৈধতা পাওয়ার আশায়।

দেশে সুশাসনের অভাব এবং হতাশা থেকে আকর্ষণীয় কর্মসংস্থানের আশায় কর্মক্ষম জনসাধারণ নিয়মিত বিদেশে পাড়ি জমিয়ে থাকে বলে জানান সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে যাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে না, তাদের অনেকেই জীবিকার তাড়নায় বৈধ ও অবৈধ উপায়ে বিদেশে অভিবাসী হয়ে থাকেন। এছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশে চাকরি পাওয়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। যারা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চাকরি পান না, তারাই মূলত বিকল্প চিন্তা করে থাকেন।

পাশাপাশি দু-তিন বছর ধরে দেশী বা বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ করছেন না। ফলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। সেসঙ্গে বাংলাদেশে নতুন ধরনের অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি হয়েছে। এতে স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার একটি প্রবণতা দেখা দিয়েছে, যা বিদেশে সম্ভব হলেও বাংলাদেশে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর সিরিয়ার অভিবাসীদের জন্য ইউরোপ তার সীমান্ত খুলে দেয়ায় বাংলাদেশীসহ অন্যান্য দেশের অভিবাসনপ্রত্যাশীরা এর সুযোগ নিয়েছেন, যা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দেশের ভাবমূর্তির স্বার্থে গভীরভাবে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে।

ইউরোস্ট্যাটের তথ্য বলছে, ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৫-এর অক্টোবর পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয় আশ্রয়প্রার্থীদের এত বিপুল সংখ্যক আবেদন জমা পড়েছে যে, তা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। যদিও এর মধ্যে সিরিয়ার নাগরিকের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। দেশটি থেকে ইউরোপে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ১৮ হাজার ৬৫০। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় চেয়ে আবেদনকারীর সংখ্যা বিবেচনায় সিরিয়ার পর রয়েছে আফগানিস্তান ও ইরাক। দেশ দুটি থেকে আবেদন জমা পড়েছে যথাক্রমে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৭০ ও ১ লাখ ৩ হাজার ৬২০।

সিরিয়া, ইরাক ও ইরিত্রিয়া থেকে আবেদনকারীদের ৭৫ শতাংশের বেশি আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। আফগানিস্তানের ৫০-৭৫ শতাংশ আবেদন মঞ্জুর করেছে ইউরোপের দেশগুলো। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান ও গাম্বিয়া থেকে জমা পড়া ১০-৫০ শতাংশ আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। এছাড়া ১০ শতাংশের কম আবেদন মঞ্জুর হয়েছে কসোভো, আলবেনিয়া ও সার্বিয়ার নাগরিকদের।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) সমন্বয়ক ড. সিআর আবরার বলেন, কিছু সুনির্দিষ্ট কারণেই রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করা যায়। কোন কোন কারণে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, তা ঢালাওভাবে না বলে প্রতিটি আবেদনই আলাদা আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কারণ প্রতিটি আবেদনের প্রেক্ষিত এক নয়।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেকোনো দেশের জন্য একটি নেতিবাচক সংকেত।বণিক বার্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.