৩ দশকে জলাভূমি-নিম্নভূমি নদী-খাল কমেছে ৫০%
ইসমাইল আলী

তিন দশক আগেও রাজধানী ঢাকা ও আশপাশে খাল ছিল ৪০টি। এর মধ্যে বর্তমানে অস্তিত্ব আছে মাত্র ১২টির। কিন্তু সেগুলোও ক্রমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনোটি এরই মধ্যে সরু নালায় পরিণত হয়েছে। একই অবস্থা জলাভূমিগুলোরও। আর ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা নিম্নভূমি তথা প্লাবনভূমিগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই কঠিন। সব মিলিয়ে সাড়ে তিন দশকে হারিয়ে গেছে ঢাকার ১০ হাজার হেক্টর বা ৫০ শতাংশের বেশি জলাভূমি, খাল ও নিম্নাঞ্চল।
জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চল ভরাট হওয়ার প্রভাব পড়ছে রাজধানীর ওপর। সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধ হয়ে পড়ছে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। গত মঙ্গলবার মাত্র ৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় রাজধানীর অর্ধেক সড়ক। গতকাল সকালেও সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয় বিভিন্ন এলাকায়। রাজধানীর জলাভূমি, নিম্নভূমি ও খাল হারিয়ে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে ইনস্টিটিউট অব
ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) সমীক্ষায়। এতে বলা হয়েছে, ১৯৭৮ সালে ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় জলাভূমির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৫২ হেক্টর ও নিম্নভূমি ১৩ হাজার ৫২৮ হেক্টর। একই সময়ে খাল ও নদী ছিল ২ হাজার ৯০০ হেক্টর। রাজধানীর বৃষ্টির পানি এসব খাল দিয়েই পড়েছে নদীতে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ক্রমেই ভরাট হয়েছে এসব জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চল। গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন, সড়ক আর শিল্প-কারখানা। পাশাপাশি খালগুলোকে সংকুচিত করে নির্মাণ করা হয়েছে বক্স কালভার্ট। এতে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে রাজধানী ও আশপাশের খাল-বিল ও জলাভূমি।
২০১৪ সালে ঢাকা ও আশপাশে জলাভূমি কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৩৫ হেক্টর, নিম্নভূমি ৬ হাজার ১৯৮ হেক্টর এবং নদী-খাল ১ হাজার ২ হেক্টর। অর্থাত্ ৩৫ বছরে জলাশয় কমেছে ৩৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এ সময়ের ব্যবধানে নিম্নভূমি কমেছে ৫৪ দশমিক ১৮ ও নদী-খাল ৬৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
আইডব্লিউএমের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ১৯৭৮ সালে ঢাকার মোট আয়তনের প্রায় ৬০ শতাংশ ছিল বিভিন্ন ধরনের জলাশয় ও নিম্নভূমি। সে সময় ঢাকায় নৌপথে যোগাযোগ ব্যবস্থাও শক্তিশালী ছিল। এর পর বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে, যার বেশির ভাগই অপরিকল্পিত। এতে নষ্ট করা হয়েছে সুবিন্যস্ত নৌ অবকাঠামো। ভরাট করা হয়েছে নদী, খাল, জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চল। খাল পরিণত হয়েছে সরু নালা বা বক্স কালভার্টে। বর্তমানে ঢাকার আয়তনের মাত্র ২১ শতাংশজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চল। এর ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই জলজট দেখা দিচ্ছে।
আইডব্লিউএমের তথ্যমতে, ঢাকার জলাভূমি, নিম্নাঞ্চল ও খাল ভরাটপ্রবণতা ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে তুলনামূলক কম ছিল। এর পর দুই দশকে বেশির ভাগ জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। ১৯৮৮ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে ঢাকার প্রায় অর্ধেক নিম্নভূমি বিলীন হয়ে যায়।
১৯৮৮ সালে ঢাকা ও আশপাশে জলাভূমি ছিল ২ হাজার ১০৪ হেক্টর, নিম্নাঞ্চল ১২ হাজার ৭১৮ হেক্টর ও নদী-খাল ২ হাজার ৫ হেক্টর। ২০০৯ সালে এগুলোর পরিমাণ কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১ হাজার ৯৯১ হেক্টর, ৬ হাজার ৪১৫ হেক্টর ও ১ হাজার ৫৮ হেক্টরে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ ঢাকায় জলাশয় ও নিম্নভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১০ শতাংশের নিচে নেমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, পানি নিষ্কাশন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ঢাকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বাড্ডা, সাঁতারকুল, খিলক্ষেত, রামপুরা, দক্ষিণ ও উত্তরখানের বেশির ভাগ এলাকা একসময় জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চল ছিল। গত এক যুগে এসব জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চলের ৯০ শতাংশ ভরাট হয়ে গেছে। মোহাম্মদপুর ও গুলশান আবাসিক এলাকায় কংক্রিটের আচ্ছাদন নেই, এমন এলাকা মাত্র ৪ শতাংশ। এজন্য অপরিকল্পিত নগরায়ণ যেমন দায়ী, একইভাবে দায়ী সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতা ও অবহেলা। এ অবস্থা চলতে থাকলে ঢাকার জলাবদ্ধতা কমানো সম্ভব হবে না।
এদিকে ঢাকাকে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ বন্যাপ্রবণ শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট: এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, বন্যাপ্রবণ শহর হিসেবে চীনের সাংহাইয়ের পরই ঢাকার অবস্থান। বাংলাদেশ সরকারের কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত এ-সংক্রান্ত সমীক্ষায় ঢাকার বিভিন্ন সমস্যাও উঠে এসেছে। ঢাকার জন্য অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বন্যা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার স্বল্পতাকে। ফলে চারপাশে নদীবেষ্টিত হওয়ার পরও ঢাকায় কয়েক দফা বড় ধরনের বন্যা দেখা দেয়।
ঢাকার জলাবদ্ধতার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্রুত নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল ও জলাভূমি ভরাট করা হচ্ছে। এছাড়া অপরিকল্পিতভাবে পয়োবর্জ্য ফেলা হচ্ছে বিভিন্ন নদী ও জলাশয়ে। ফলে বছরে গড়ে মাত্র দুই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলেও তা নিষ্কাশন করা সম্ভব হচ্ছে না। কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই জলমগ্ন হয়ে পড়ছে রাজধানী।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, জলাভূমি ভরাটের ফলে শহর থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা বাড়ছে। এজন্য জনগণ যেমন দায়ী, তেমনি সরকারেরও অবহেলা রয়েছে। জনগণ নিম্নভূমি দখল করে বা কিনে নিয়ে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করছে। এগুলো বন্ধে সরকারের বহু আগেই ব্যবস্থা নেয়া দরকার ছিল, যা করা হয়নি। ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) করে অনেক পরে এ উদ্যোগ নেয়া হলেও এখন আবার তা সংশোধনের নামে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ফলে ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করা কঠিন হয়েছে।
ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে নিম্নাঞ্চল ও জলাভূমিগুলোকে মুক্ত করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ২০ বছর মেয়াদি প্রস্তাবিত ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানে। এতে বলা হয়েছে, ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এজন্য দখলমুক্ত করতে হবে ঢাকার আশপাশের খাল-বিলগুলো। নিম্নভূমি বা জলাশয় ভরাট বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে শহরে কয়েকটি লিফট স্টেশন করতে হবে। এর মাধ্যমে পাম্প করে পানি টেনে বের করতে হবে।
আইনুন নিশাত এ প্রসঙ্গে বলেন, সাধারণত বর্ষায় নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। এজন্য বিদ্যমান ব্যবস্থায় পানি নেমে যেতে সমস্যা হয়। ফলে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে পানি উল্টো দিকে ফিরে আসার মতো অবস্থা হয়। এজন্য সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে পাম্প স্টেশন বসানো যেতে পারে। তবে খাল-বিলগুলো দখলমুক্ত করা অতি জরুরি।
তিনি আরো বলেন, ২০১১ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে যে নতুন ধারা সংযোজিত হয়েছে, সেখানে জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্য ঢাকার জলাভূমি ও নিম্নভূমি রক্ষার পাশাপাশি নদীগুলো রক্ষায়ও উদ্যোগ নিতে হবে।