৫০০ স্বাদের চায়ের কাপে স্বপ্ন ঘোরে সোহেলের
৫০০ স্বাদের চায়ের কাপে স্বপ্ন ঘোরে সোহেলের
আমিনুল ইসলাম : চা পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়। আমাদের দেশে সাধারণত লাল চা ও দুধ চা সর্বাধিক প্রচলিত। একজন চায়ের দোকানদার কিংবা সেইরকম চাখোর কাউকে যদি কয়েক প্রকার চায়ের নাম বলতে বলা হয়, তাহলে কয়টা বলতে পারবেন? পাঁচ কিংবা ১০টি? কিংবা তারও বেশি! কিন্তু রাজশাহীর টিবি পুকুর বাইপাস চত্বরের সোহেলের চায়ের দোকানে রয়েছে ৫০০ প্রকারের চা! কি, অবাক হচ্ছেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটিই সত্য। যারা রাজশাহীতে গেছেন কিংবা রাজশাহীতে থাকেন তাদের কাছে নতুন করে সোহেলের চায়ের দোকানের কথা বলতে হবে না। এক বাক্যেই চেনেন তারা।
সোহেলের দোকানের বিভিন্ন প্রকারের চা ও কফির মূল্য তালিকা (ছবি : আমিনুল) আগে ভাগেই একটু বলে রাখি, ৫০০ প্রকারের চা স্বাদের বিচারে, চায়ের প্রকারের বিচারে নয়। বিভিন্ন প্রকার চায়ের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন উপকরণ মিশিয়ে নানা স্বাদের চা তৈরি করেন সোহেল। এখানেই তার মুন্সিয়ানা। বর্তমানে সোহেলের চায়ের দোকানে পাঁচজন কর্মচারী রয়েছেন। তবে সোহেলই নিজ হাতে বিভিন্ন প্রকারের চা তৈরি করে থাকেন। যাতে চায়ের মান বজায় থাকে। তবে তার জীবনের শুরুটা আড়ম্বরপূর্ণ ছিল না। শুরুটা হয়েছিল হাড়ভাঙা খাটুনি ও বঞ্চনার গল্প দিয়ে।
বিভিন্ন প্রকারের চা ও কফি তৈরির উপকরণ (ছবি : আমিনুল) নয় বছর বয়স থেকে চায়ের দোকানে কাজ করা শুরু করেন সোহেল। তারপর বিভিন্ন হোটেল, রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। এক পর্যায়ে রাজশাহীর টিবি পুকুর বাইপাস চত্বরে এই দোকান দেন তিনি। সেটা অবশ্য ২০০০ সালের ঘটনা। প্রথমে এই দোকানে শুধু লাল চা আর দুধ চা বিক্রি করতেন তিনি। তাতে কোনো রকমে টেনেটুনে সংসার চলছিল। নিজেই ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে চা বিক্রি করতেন সারা দিন। একবার রোজার সময়। চা খুব বেশি বিক্রি হয়নি। সেবার ঈদের খুশিও ধরা দেয়নি তার সংসারে। ছেলেমেয়ের জন্য কিনতে পারেননি ঈদের পোশাক। তা ছাড়া তখন দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার জন্য বাজার করার টাকাও থাকত না তার। এজন্য খুব কষ্ট হতো। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে রাতে বাসায় ফিরতেন। কিন্তু ঘুমাতে পারতেন না। নানা রকম ভাবনায় রাত গভীর হতো তার। তার এই ভাবনাজুড়ে ছিল কীভাবে দোকানের বিক্রি বাড়ানো যায়। সুযোগ পেলেই বিভিন্ন দোকানে যেতেন, আর দেখতেন অন্যদের দোকানে কী কী আছে। কী করলে তাদের চেয়ে তার দোকান আলাদা হবে ও বিক্রি বাড়বে। তখন তার মাথায় বুদ্ধি আসে। চায়ের আইটেম বাড়াতে হবে। পাশাপাশি চা মানসম্মত করতে হবে। তখন থেকে ধীরে ধীরে একটা দুইটা করে আইটেম বাড়াতে থাকেন তিনি। দেখতে দেখতে লোকজনও বাড়তে শুরু করেছে। ঘুরতে লাগল ভাগ্যের চাকা। ছড়িয়ে পড়তে থাকল তার চায়ের দোকানের নামডাক। এখন সবাই একনামে চেনে তাকে ও তার চায়ের দোকানকে। তিনি এখন রাজশাহী নগরীর সিটি বাইপাস মোড়ের সোহেল চা অ্যান্ড কফি হাউসের মালিক। এখন তার দোকানে পাঁচ শতাধিক রকমের চা ও কফি পাওয়া যায়। শিগগিরই আরো ১০ রকমের চা ও কফি যুক্ত হবে তার মেন্যুতে। পাঁচজন কর্মচারী খাটে তার স্টলে। পঞ্চগড়, সিলেট ও চট্টগ্রাম থেকে চা সংগ্রহ করেন সোহেল। আর দেশের বাইরে ভারতের দার্জিলিং, শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়ার চাও পাওয়া যায় তার দোকানে। সর্বনিম্ন ৫ টাকার লাল চা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪৫০ টাকার সিল্কি চকলেট চা পাওয়া যায় তার দোকানে। তবে সব কিছুর দাম বাড়ায় শিগগিরই তার বিভিন্ন প্রকারের চায়ের দামও বাড়াবেন।
কয়েক প্রকারের চায়ের নমুনা তার দোকানে চা পান করতে আসে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যালের শিক্ষার্থী থেকে শুরু আপামর জনসাধারণ। স্থানীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা ডিসি, এসপি, থানার দারোগারাসহ চিকিৎসকরা আসেন সোহেলের দোকানে, ভিন্নধর্মী এক কাপ চায়ের স্বাদ নিতে। এ ছাড়া রাজশাহীর বাইরের থানা থেকেও চা পান করতে লোকজন আসে। তার মধ্যে পশ্চিম দিকের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও গোদাগাড়ী থেকে, পূর্ব দিকের বানেশ্বর ও উত্তর দিকের মান্দা থেকে প্রতিদিন তার দোকানে লোকজন আসে। এজন্য তিনি কোনো দিন হুট করে দোকান বন্ধ করেন না। বন্ধ করলেও কয়েকদিন পূর্বেই নোটিস টাঙিয়ে দেন ও যারা চা খেতে আসে তাদের বলে দেন ওই দিন দোকান বন্ধ থাকবে। যাতে দূর থেকে এসে কেউ যেন না দেখেন দোকান বন্ধ। যাতে কাস্টমাররা দোকান বন্ধ পেয়ে মন খারাপ না করেন। সোহেল টি অ্যান্ড কফি হাউস সকাল ৭টার সময় খোলে। দুপুরে শুধু দুই ঘণ্টার জন্য শহরের দাশপুকুর এলাকার বাসায় যান সোহেল। একটু বিশ্রাম এবং খাওয়া শেষে ফিরে আসেন। দুপুরে বাসায় যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যান তার মাদ্রাসা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া ছেলেকে ও লক্ষ্মীপুর গার্লস স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া মেয়েকে। দুপুরে খেয়ে এসে রাত ১২টা পর্যন্ত দোকান চালান। বন্ধ করতে করতে রাত ১টা। এখন তার প্রতিদিনের আয় ঈর্শ্বনীয়। স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুখেই দিন কাটছে তার।
নতুন বিভিন্ন প্রকারের চা ও কফির মূল্য তালিকা দোকানে পাঁচজন কর্মচারী থাকা সত্ত্বেও সোহেল একাই নিজ হাতে চা বানান। কোনো কর্মচারীকে চা বানাতে দেন না। দুপুরে খেতে গেলে তখন তার এক ছোট ভাই চা বানায়। তাও শুধু দুধ চা আর লাল চা। চায়ের মান ধরে রাখার জন্যই তার এই ব্যবস্থা। সোহেলের মতে, চায়ের মান ভালো হলেই তবে কাস্টমার চা খেতে আসবে। এ জন্য কষ্ট হলেও সে নিজেই চা বানান। অন্য কাউকে চা বানাতে দেন না। গরমের সময় তার দোকানে দুই মণের মতো দুধ লাগে। শীতকালে লাগে তিন থেকে সাড়ে তিন মণ।
সোহেলের দোকানের ধূমায়িত লেমন চা (ছবি : আমিনুল) তার দোকান নিয়ে অনেক স্বপ্ন রয়েছে। দোকানকে আরো অনেক বড় করতে চান। নতুন নতুন আইটেম উদ্ভাবন করতে চান তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার দোকানের একটি পেইজ রয়েছে ( https://www.facebook.com/pages/Sohel-Tea-Coffee-Shop/828911973821359)। ৩৪ বছর বয়সি সোহেলের এই ৫ শতাধিক প্রকারের চায়ের কাপে যেমন তার নিজের স্বপ্ন ঘোরে, তেমনি ঘোরে এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের স্বপ্নও। নতুন নতুন স্বপ্ন নিয়ে তারা এখানে আড্ডা জমায়। আর সোহেলের ৫০০ প্রকারের চায়ের কাপে চুমুক দেয়।






সূত্র: আমার বাংলাদেশ।