ওয়েসিস অব দ্য সিস: সাগরের বুকে ভাসমান এক শহর
ওয়েসিস অব দ্য সিস: সাগরের বুকে ভাসমান এক শহর
‘টাইটানিক’ জাহাজের নাম এলেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজের নাম চলে আসে। তবে আভিজাত্য ও আকারের দিক থেকে ‘ওয়েসিস অব দ্য সিস’ টাইটানিকের চেয়ে অনেক এগিয়ে। এটা ৫টা টাইটানিকের চেয়েও বড় কিংবা ৪ টা ফুটবল মাঠের চেয়েও বড়। এতোদিন পৃথিবীতে সর্ববৃহৎ জাহাজ হিসেবে খ্যাত ছিলো ইনডিপেন্ডেন্স/ফ্রিডম অফ দ্য সিস যার তুলনায় ওয়েসিস অফ দ্য সিস পাক্কা ৭৫ ফুট বেশি লম্বা। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও বিলাসবহুল জাহাজের নাম ‘ওয়েসিস অফ দ্য সিস’। যার বাংলায় অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘সাগরের মরূদ্যান’।
নির্মাণ সংক্রান্ত তথ্য:
- মালিকানা: রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল
- নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান: এসটিএক্স ইউরোপ
- খরচ: ১.৫ বিলিয়ন ডলার (প্রায়)
- নির্মাণকালীন সময়: সাড়ে তিন বছর
- নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ: ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি
- নির্মাণ কাজ শুরুর সময়: ২০০৭ সালের ১২ নভেম্বর
- নির্মাণ কাজ শেষের সময়: ২০০৯ সালের ১ নভেম্বর
- ওজন: ২ লাখ ২৫ হাজার ২৮২ টন (টাইটানিকের ওজন ছিল ৮৬ হাজার ৩২৮ টন)
- আয়তন: দৈর্ঘ্য ১১৮৭ ফুট, প্রস্থঃ ২০৮ ফুট, ড্রাফট (সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে তলায় কীল পর্যন্ত) ৩০ ফুট
জাহাজটির গঠন ও ধারণক্ষমতা:
২২ তলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল এই জাহাজটিতে রয়েছে ১৬টি ডেক এবং ২,৭০০ টি বিলাসবহুল রুম। জাহাজটি একসাথে ৬,৩০০ যাত্রী ধারণ করতে পারে। সেই সাথে জাহাজটিতে অবস্থান করে ২,১০০ ক্রু।
চোখ ধাঁধানো যেসব বিষয় রয়েছে:
জাহাজটির প্রতি পরতে পরতে রয়েছে বিস্ময়ের ছাপ। মোট ৭টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে জাহাজের বিশেষত্বকে। যেমন – সেন্ট্রাল পার্ক, পুল, ফিটনেস সেন্টার, বিনোদন কেন্দ্র প্রভৃতি। বিশ্বের প্রথম ভাসমান উদ্যানটি এই জাহাজেই অবস্থিত। যেখানে ১২ হাজার গাছের চারা এবং ৫৬টি গাছ রয়েছে। জাহাজের পেছনের অংশে রয়েছে ৭৫০টি আসন বিশিষ্ট থিয়েটার, যার মধ্যে রয়েছে সুইমিং পুল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জাহাজের এই জায়গাটি দিনে ব্যবহৃত হয় সুইমিং পুল হিসেবেই অথচ রাতে ব্যবহৃত হয় সাগরের একটি থিয়েটার হিসেবে।
যাঁরা সমুদ্রে সার্ফ করতে ভয় পান তাঁদের সার্ফিং করা জন্য বানানো হয়েছে জাহাজের মধ্যেই দুটি সার্ফ এরিয়া। একটি পূর্ণবয়স্কদের জন্য, আরেকটি শিশুদের জন্য। নাম দেওয়া হয়েছে ফ্লো রাইডার্স। যাঁরা যথেষ্ট সাহসী তাঁদের জন্য আছে ওড়ার ব্যবস্থা। গ্লাইডিং করে জাহাজের ছাদের ২৫ মিটার ওপর পর্যন্ত ওড়া যায়। জিপ ওয়্যার ধরে তীব্র গতিতে ওপরে ওঠানামার খেলার ব্যবস্থাও আছে।পর্বতারোহনে উৎসাহীদের জন্য পাথরের দেয়ালে তৈরি করা হয়েছে ১৩ মিটার উচ্চতার দুটি টাওয়ার।
কেবিন বা থিয়েটার ছাড়াও জাহাজের প্রায় প্রতিটি অংশেই রয়েছে অসংখ্য বার, পোশাক ও বিভিন্ন দ্রব্যাদির দোকান আর রেস্টুরেন্ট। এছাড়াও রয়েছে ভলিবল কোর্ট, বাস্কেটবল কোর্ট, চারটি বিশালাকৃতির সুইমিং পুল, জাহাজে আরো রয়েছে ইয়ুথ জোন, যেখানে আছে কম্পিউটার গেমিং ও সাইন্স ল্যাবরেটরিসহ নানা আকর্ষণীয় বিষয়, থিম পার্ক এবং বাচ্চাদের জন্য বিশেষ নার্সারি ও খেলাধূলার স্থান। আর পায়ে হেঁটে বেড়ানোর জন্য সুদৃশ্য জায়গা তো আছেই।
জাহাজে করে সুমুদ্রের বুকে ঘুরে বেড়াতে চাইলে:
বিলাসবহুল এই জাহাজে করে ক্যারিবিয়ান সাগরের বুকে ভেসে বেড়াতে চাইলে আপনাকে গুণতে হবে ভিতরের দিকে কেবিন ভাড়া ১৪৫৮ মার্কিন ডলার এবং দ্বিতল বিশিষ্ট সমুদ্রের দিকে মুখ করা সুইট ভাড়া ৩২০০ মার্কিন ডলার। মোট ৯ রাত, ৯ দিন উত্তর ক্যারিবিয়ান সাগরের বুকে আপনি এই জাহাজে করে ঘুরতে পারবেন। তবে এই জাহাজের যাত্রী হতে হলে আপনাকে ২ বছর আগে বুকিং দিতে হবে।
যেভাবে পরিচালিত হয় জাহাজটি:
- ৭১ টি দেশের প্রায় ২৪০০ জন ক্রু নিয়োজিত রয়েছেন জাহাজটি পরিচালনায়। দিন রাত ২৪ ঘন্টা পালা ক্রমে ক্রুরা নানা কাজ করছে। শুধু জানালার কাচে জমা নোনা জল পরিষ্কার করার জন্য ডজন খানিক ক্রু এবং ১৮টা রোবট কাজ করছে।
- ২৪ ঘন্টা ধরে এর লন্ড্রিতে ৩৪ জন ক্রু কাজ করছে যাদেরকে দিনে প্রায় ২০,০০০ টেবিল ক্লথ, ন্যাপকিন, বিছানার চাদর, তোয়ালে ধোয়া, ইস্ত্রি করা এবং ভাজ করতে হয় তবে চাদর, ন্যাপকি্ন , টেবিল ক্লথ ইস্ত্রি করে বিশাল আকারের মেশিন কিন্তু তোয়ালে ও টেবিল ন্যাপকিন নানা ডিজাইন করে ভাজ করার কাজ হাতেই করতে হয়।
স্বাস্থ্য সমস্যা হলে:
ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট সহ ৩ জন ডাক্তার আছে, ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে এক জন মানুষের যাবতীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। এমনকি হার্ট এটাক হলেও তার চিকিৎসার যাবতীয় আয়োজন আছে। প্রতি যাত্রায় অন্তত একটি এ ধরনের প্রয়োজন দেখা দেয়। তবে ক্ষেত্র বিশেষে জাহাজের ডাক্তার এবং ক্যাপটেন পরামর্শ করে জাহাজের দিক পরিবর্তন করে নিকটস্থ বন্দরে ভেড়াবার ক্ষমতা দেয়া আছে, মাঝে মাঝে রোগীকে হেলিকপ্টারে করে স্থানান্তর করার ব্যবস্থাও আছে। জাহাজে যে ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয় তার মধ্যে খাদ্য সংক্রান্ত পেটের অসুখ, পিঠে ব্যাথা, গলায় ইনফ্যাকশন, সাইনুসাইটিসের চিকিৎসাই বেশি। প্রতি যাত্রায় ২০০০-৩০০০ meclizine ব্যবহার হয় যা কেবল মাত্র সী সিকনেসের যেমন জাহাজের রোলিং পিচিং এর কারনে বমি রোধকের জন্য
খাবার-দাবার:
৮৭০০ মানুষের খাবার ব্যবস্থার জন্য ২৬টা গ্যালি বা রান্না ঘরে যাত্রীদের সকালে ঘুম ভাঙ্গার আগে থেকেই রান্নার কাজ চলতে থাকে। এই সব মালামাল জাহাজের মাতৃভুমি (Port of Registry) Fort Lauderdale শহরের Port Everglades বন্দর থেকে প্রতি শনিবার প্রায় সকাল ৬টা থেকে জাহাজে্র ডেকে এসে পৌঁছতে থাকে এবং সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সেগুলি চাহিদার তালিকার সাথে মিলিয়ে বাছাই করে ভাঙ্গা প্যাকেট, পচা ইত্যাদি সরিয়ে ফেলে ফর্ক লিফটে করে ভান্ডারে নির্দিষ্ট জায়গা অনুযায়ী স্টোরিং হতে থাকে। যেমন, চা, কফি, দুধ, মাছ, মাংশ, চাউল, ময়দা, বিস্কুট, সব্জী, সস, কেচাপ, মাখন, পনীর, রুটি, নানা ধরনের মদ এবং পানীয় ইত্যাদি যেটা যেখানে রাখতে হয় সেখানে রাখা হয়।বিভিন্ন গ্যালিতে বিভিন্ন রকমের খাবার রান্না হয়, যেমন যে গ্যালিতে মাছ মাংশ রান্না হয় সেখানে সব্জী রান্না বা বেকিং হবে না আবার সকালের নাস্তা বা হালকা নাস্তার জন্য ভিন্ন গ্যালি এই ভাবে।
নামকরণ:
নির্মাণ শুরুর আগে রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ‘নেম দ্যাট শিপ’ নামের এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্নস্থান থেকে প্রায় ৯১ হাজার নাম সংগৃহীত হয়। বিপুল সংখ্যক নাম থেকে বেছে অবশেষে মিশিগানের জর্জ ওয়েজারের পাঠানো ‘ওয়েসিস অব দ্যা সিজ’ নির্বাচন করা হয়।
এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ নয়:
বিভিন্ন মাধ্যমে ‘ওয়েসিস অব দ্য সিস’কে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ বলা হলেও এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ নয়। একই কোম্পানির আরও একটি জাহাজ রয়েছে। যেটির নাম ‘অ্যালিউর অব দ্যা সিজ’। মাত্র ২ ইঞ্চি পার্থক্য রয়েছে জাহাজ দুটির আয়তনের মধ্যে। ‘অ্যালিউর অব দ্যা সিজ’ ২ ইঞ্চি বড় ‘ওয়েসিস অব দ্য সিস’ থেকে। সূত্র: অন লাইন ঢাকা গাইড।