সাদা পাহাড়ের রাজ্যে

মো: আব্দুর রহমান

  অপার সৌন্দর্যের আমাদের এই বাংলাদেশ। দেখার মতো কী নেই আমাদের? শুধু বেরিয়ে পড়ার অপেক্ষা। প্রকৃতি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
শীতের শুরুতেই তাই ঘুরে আসা যেতে পারে সীমান্তের কাছাকাছি সাদা মাটির পাহাড়ে। এই সাদা মাটির পাহাড় বিরিশিরিতে অবস্থিত।
বিরিশিরি নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত। আমরা সবাই চা খেয়ে পাঁচটি রিকশা ভাড়া করে চললাম বিরিশিরির অপার সৌন্দর্য দেখার জন্য। পথিমধ্যে পেলাম সোমেশ্বরী নদী। সমস্যা একটাই, সাদা মাটির পাহাড়ে যেতে হলে সোমেশ্বরী নদীর দীর্ঘ ডথ পাড়ি দিতে হবে। তবে দল বেঁধে গেলে দীর্ঘ পথ একেবারেই ছোট মনে হবে। কারণ খনিজসম্পদ আহরণের জন্য স্থানীয়রা সারাক্ষণ নদীর বুকে দাপিয়ে বেড়ায়। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য আপনাকে আকৃষ্ট করবেই।
সোমেশ্বরী নদীকে বিরিশিরির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যমণি বলা যায়। চার পাশে পাহাড়ে ঘেরা সোমেশ্বরীর উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে পানির রঙও পাল্টায়। আমরা এই নদী নৌকায় পার হলাম। গ্রীষ্ম মওসুমে এ নদী হেঁটে পার হওয়া যায়। সোমেশ্বরী নদীর কোল ঘেঁষেই রানীখং মিশনটি একটি উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত।
১৯১০ সালে এ রানীখং মিশন স্থাপিত হয়, যেখান থেকে প্রকৃতিকে আরো নিবিড়ভাবে উপভোগ
করা যায়। মিশনের পাশেই সোমেশ্বরী নদী। কিছুক্ষণ বসে শরীর জুড়িয়ে নেয়া যেতে পারে এখানে। কিংবা চাঁদের আলোর অপার সৌন্দর্যও কম নয়।
নদী পার হয়েই গেলাম বিজয়পুরে অবস্থিত চীনামাটির পাহাড়। বিরিশিরির মূল আকর্ষণ হচ্ছে এই চীনামাটির পাহাড়, যার বুক চিরে জেগে উঠেছে নীলচে-সবুজ পানির হ্রদ।
ছোট-বড় টিলা-পাহাড় ও সমতল ভূমিজুড়ে প্রায় ১৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৬০০ মিটার প্রস্থ এই খনিজ অঞ্চল।
খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ১৯৫৭ সালে এ অঞ্চলে সাদা মাটির পরিমাণ ধরা হয় ২৪ লাখ ৭০ হাজার মেট্র্রিক টন, যা বাংলাদেশের ৩০০ বছরের চাহিদা পূরণ করতে পারে।
খনিগুলো থেকে মাটি খনন করায় এসব হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে। সাদা মাটি পানির রঙ যেন আরো বেশি গাঢ় করে দিয়েছে। সবাই মিলে পাহাড়ে উঠলাম, ছবি তুললাম, হ্রদের পানিতে নেমে নিজেদের জুড়িয়ে নিলাম। হ্রদের পানি এক জায়গায় সবুজ তো অন্য জায়গায় নীল। গোসল করার কোনো প্রস্তুতি নিয়ে যাইনি বলে সবাই আফসোস করলাম। ভাবলাম, পরের বার যদি আসি, তাহলে শুধু গোসল করার জন্যই আসব।
পাহাড় থেকে নেমে গেলাম পাহাড়ি কালচারাল একাডেমি। এখানকার আদিবাসীদের ৬০ শতাংশই গারো, হাজং ইত্যাদি নৃগোষ্ঠীর। এখানে আছে টুঙ্কা বিপ্লবের কয়েকটি স্মৃতিস্তম্ভ।
গারো ও হাজং ছাড়া প্রায় সব ক’টি গোষ্ঠীই বাংলা ভাষাভাষী। সেখান থেকে গেলাম সেন্ট যোসেফের গির্জায়। গির্জাটা বেশ সাজানো-গোছানো,
নীরব আর খুব সুন্দর। গির্জার সামনেই
রয়েছে যিশুর মূর্তি। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯১২ সালে। এখানে কর্তব্যরত সিস্টাররা জানালেন প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাস। বিভিন্ন স্থাপনার মধ্যে
এখানে রয়েছে যিশু খ্রিষ্টের মূর্তি, শিশুদের বিদ্যাপাঠের স্থান ও বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন। সেখান থেকে গেলাম বিজয়পুর ক্যাম্প, যেখানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। সেখান থেকে ফিরে গেলাম রামকৃষ্ণ মন্দির এবং সবশেষে লোকনাথ মন্দির।
এবার ফেরার পালা। পথিমধ্যে আবার দেখা হলো সোমেশ্বরী নদীর সাথে। শেষ বিকেলের আলোয় নদীর সৌন্দর্য আমাদের গ্রাস করে নিচ্ছিল। নয়নাভিরাম পানির ঢেউয়ের টান ছিল বারবার। দুর্গাপুর ফিরে সবাই দুপুরের খাবার খেলাম। অতঃপর সাদা মাটির দেশকে বিদায় জানিয়ে ক্যাম্পাসে সন্ধ্যার আগেই ফিরে এলাম।
যাওয়ার সময় সবার মধ্যে যে আনন্দ ছিল, তা ফেরার পথে কিছুটা ম্লান হয়েছিল শুধু আবার ফিরে আসার প্রতীক্ষায়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.