জলজ পরিবেশে অবাধে ব্যবহার হচ্ছে কীটনাশক ও রাসায়নিক
জেসমিন মলি
বছর পাঁচেক আগেও কক্সবাজারের বাঁকখালীতে মাছ মিলত ২০-৩০ প্রজাতির। নদীর সর্বত্রই দেখা যেত লাল কাঁকড়া। সেই বাঁকখালীতেই এখন মাছ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র দু-তিন প্রজাতির। আর লাল কাঁকড়ার তো দেখাই নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাঁকখালী মাছশূন্য হওয়ার জন্য দায়ী মূলত কীটনাশকের অবাধ ব্যবহার। কারণ নদীর বিস্তীর্ণ তীরজুড়ে প্রতি বছর আবাদ হচ্ছে তামাক। এতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক, যা সরাসরি গিয়ে মিশছে নদীতে। এতে অনেক মাছ মারা যাচ্ছে। কিছু মাছ আবার অন্যত্র চলে যাচ্ছে।
কীটনাশকসহ নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার হচ্ছে পুকুর কিংবা ঘেরেও। এগুলো ব্যবহার হচ্ছে অবাঞ্ছিত মাছ নিধন ও পুকুর মাছ চাষের উপযোগী করতে। দ্রুত উত্পাদন পেতে ব্যবহার করা হচ্ছে বর্ধনশীল বিভিন্ন ওষুধ।
ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে জলাশয়ে কীটনাশকের অবাধ ব্যবহারের এ তথ্য পেয়েছে সরকারের মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। মাছ ও জলজ পরিবেশ এমনকি মানবদেহেও এর ক্ষতিকর প্রভাব উঠে এসেছে ইনস্টিটিউটের ওই গবেষণায়। তাতে বলা হয়েছে, কীটনাশকের অবাধ ব্যবহারে জলজ জীব ক্রমান্বয়ে প্রজনন ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। মানুষের খাদ্য হিসেবে এভাবে উত্পাদিত মাছে গ্রহণযোগ্যতা কমে আসছে।
জানতে চাইলে মত্স্য অধিদফতরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিত্যরঞ্জন বিশ্বাস বণিক বার্তাকে বলেন, মাছ চাষে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ রাসায়নিক ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আমরা নিয়মিত বিষয়টি তদারকির মধ্যে রাখি। খামারিদের সচেতনতা বাড়াতে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণও দেয়া হয়।
মত্স্য খামারগুলোয় কীটনাশকের পাশাপাশি অন্তত ৫০ ধরনের রাসায়নিক ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছে মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। এর মধ্যে ১৫ ধরনের কীটনাশক রয়েছে, যেগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়। এগুলোর মধ্যে আছে— রেনামাইসিন, অ্যামোক্সিফিশ, টিমসেন ও অ্যাকোয়ামাইসিন। মাছের উত্পাদনশীলতা বাড়াতে এগুলো ব্যবহার করছেন খামারিরা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক শহীদুর রহমান বলেন, তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাজারে এমন সব রাসায়নিক পাওয়া যায়, যা বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ। কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে চাষের মাছ মানবদেহের জন্যও ক্ষতিকর। এ বিষয়ে সতর্ক থাকার বিকল্প নেই।
আশির দশকের মধ্যভাগ থেকেই মূলত দেশে পুকুরে মাছ চাষের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে বিভিন্ন রাসায়নিকের ব্যবহারও। এসব রাসায়নিকের কোনো কোনোটি ব্যবহার হচ্ছে পানির মান ভালো করতে, কোনোটি আবার অবাঞ্ছিত মাছ ধ্বংসের জন্য। কোনো কোনো রাসায়নিক ব্যবহার হচ্ছে মাছের উত্পাদন বাড়াতে। যদিও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারই বেশি হচ্ছে এসব রাসায়নিকের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাছের খাদ্য হিসেবে ফাইটোপ্ল্যাংকটন উত্পাদনে পুকুরে ব্যবহার করা হচ্ছে ইউরিয়ার মতো রাসায়নিক সার। কিন্তু তা মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে দূষিত হয়ে পড়ছে পানি। হাইড্রোজেন সালফাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অ্যামোনিয়া দূর করতে ব্যবহার করা হয় জিওলাইট নামে এক ধরনের রাসায়নিক। এটি বেশি ব্যবহার করছেন চিংড়িচাষীরা। যদিও এর কার্যকারিতা নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়েছে। এছাড়া পুকুর প্রস্তুতকরণ ও অযাচিত মাছ মেরে ফেলতে ব্যবহার করা হচ্ছে ডায়াজিনন, ম্যালাথিয়ন ও ডিডিটির মতো বিষাক্ত রাসায়নিক।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিমাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে চাষ করা মাছ মানবদেহের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্বল্পমাত্রার ডিডিটিও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি শরীরে একবার প্রবেশ করলে এর প্রভাব থাকে সারা জীবন। সৃষ্টি হতে পারে ক্যান্সারসহ নানা রোগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক গোলাম মাওলা বলেন, মাছ চাষে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও ডিডিটির ব্যবহার কোনো অবস্থায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। ডিডিটি কেবল ব্যবহারকারীর জন্যই নয়, পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও ক্ষতির কারণ হতে পারে।
তবে জলজ পরিবেশে রাসায়নিক ও কীটনাশকের ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধে কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সরকার। এর আওতায় মত্স্য চাষে ব্যবহূত ওষুধ ও রাসায়নিক দ্রব্যাদির তালিকা প্রণয়ন এবং উত্স নিরূপণ করা হবে। পাশাপাশি মত্স্যচাষী ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো হবে এগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে।
মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এ প্রকল্পের আওতায় ময়মনসিংহের স্বাদু পানি কেন্দ্র, কক্সবাজারের সামুদ্রিক মত্স্য ও প্রজনন কেন্দ্র এবং বগুড়ার প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রের ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব নিরূপণ করা হবে ।Bonik Barta